নাটোরে সড়ক দুর্ঘটনায় বাবা-মায়ের মৃত্যুর ৪ দিন পর ছেলেরও মৃত্যু!

বিশেষ প্রতিবেদকঃ
নাটোরের বড়াইগ্রামের বনপাড়া পৌরশহরের পূর্ব কালিকাপুর মহল্লা যেন এক নীরব শ্মশানে পরিণত হয়েছে, যেখানে এক সাধারণ সোমবারের দুপুরের আনন্দময় যাত্রা মৃত্যুর কালো ছায়ায় ঢেকে গেছে। স্বপরিবারে বিয়ের দাওয়াতে যাওয়ার পথে নাটোর-কুষ্টিয়া মহাসড়কের গুনাইহাটি এলাকায় বাসের সাথে ব্যাটারী চালিত অটোভ্যানের ভয়াবহ সংঘর্ষে যেন এক পরিবারের স্বপ্ন চুরমার হয়ে গেছে। ঘটনাস্থলেই মৃত্যুবরণ করেন বাবা আনছার আলী (৬২), যিনি সমাজসেবা অধিদপ্তরের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ছিলেন—তাঁর চোখে তখনও ছিল মানিকপুরের বিয়ের বাড়ির হাসির ছবি। এর মাত্র ১১ ঘণ্টা পর, রাত ১টার দিকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউ-তে শেষ নিঃশ্বাস ফেলেন মা রাশিদা বেগম (৫৬), যাঁর হাতে এখনও লুকিয়ে ছিল ছেলেদের জন্য নতুন জামার কাপড়ের স্পর্শ। আর চার দিন পর, শনিবার দুপুর ১টায় সেই একই হাসপাতালের বিছানায় বড় ছেলে মাসুদ রানা (৩৮) মৃত্যুর সাথে পঞ্জা লড়ে হেরে যান—তাঁর চোখে জ্বলছিল বাবা-মায়ের অসমাপ্ত স্বপ্নের আলো, যা এখন চিরকালের অন্ধকারে মিলিয়ে গেছে। ছোট ছেলে রাসেল হোসেন (২৬) ছোটখাটো আঘাতে এখন আশঙ্কামুক্ত, কিন্তু তাঁর কাঁধে এখন পড়েছে এক পরিবারের ভার—যেন একা একা বহন করতে হবে সেই অসহ্য শোকের ওজন।
সেই সোমবার দুপুরের সোনালি আলোয়, বনপাড়া গুনাইহাটির মোড়ে যেন মৃত্যুর হাত চলে এসেছিল দ্রুতগতির বাসের চাকায়। অটোভ্যানটি সাইড পরিবর্তন করতে গিয়ে বাসের সামনে এসে পড়ে, আর সংঘর্ষের শব্দে কেঁপে উঠেছিল পুরো এলাকা। ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান আনছার আলীসহ অটোভ্যানের চালক লালপুরের ধলা গ্রামের মুনছের প্রামাণিক (৬৫) এবং যাত্রী নয়ন ইসলাম (২৮)—তাঁদের মৃত্যু যেন এক মুহূর্তে ছিন্ন করে দিয়েছে তিনটি পরিবারের আশা। আহত রাশিদা বেগম এবং দুই ছেলেকে স্থানীয়রা উদ্ধার করে রাজশাহী মেডিকেল কলেজে পাঠান, যেখানে চিকিৎসকেরা দিনরাত লড়াই করেছেন মৃত্যুর সাথে। কিন্তু একে একে হেরে যান তাঁরা—প্রথমে মায়ের হৃদয় থেমে যায়, তারপর বড় ছেলের শরীরের সংগ্রাম শেষ হয়। এই তিন মৃত্যু যেন এক পরিবারের ধ্বংসলীলা, যেখানে বিয়ের দাওয়াতের আনন্দ মাত্র কয়েক ঘণ্টায় পরিণত হয়েছে শ্মশানের ধোঁয়ায়। বনপাড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ সুমন চন্দ্র দাসের কণ্ঠে ফুটে ওঠে ঘটনার ভয়াবহতা: “এই সংবাদের সত্যতা নিশ্চিত। দুর্ঘটনার তদন্ত চলছে, এবং আমরা বাসের চালকের দায়িত্ব নিয়ে পদক্ষেপ নেব।”
এই দুর্ঘটনা কেবল একটি সংঘর্ষ নয়, একটি সমাজের ক্ষত—যেখানে সাধারণ মানুষের জীবন যেন সড়কের ধুলোয় মিশে যায় দ্রুতগতির যানবাহনের সামনে। বড়াইগ্রামের এই ছোট্ট মহল্লায় এখন শোকের কালো পতাকা উড়ছে, যেখানে রাসেলের চোখের জলে ভেসে যাচ্ছে বাবা-মা-ভাইয়ের স্মৃতি। এই ট্র্যাজেডি যেন একটি সতর্কবাণী—সড়কের নিরাপত্তা, চালকের দায়িত্ববোধ এবং যানবাহনের গতিসীমা নিয়ে আমাদের সকলকে জাগতে হবে, যাতে আর কোনো পরিবারের স্বপ্ন এমনভাবে চুরি না যায়। আনছার, রাশিদা এবং মাসুদের মৃত্যু যেন চিরকালের জন্য মনে রাখিয়ে দেয়, জীবনের মূল্য কতটা অমূল্য, আর এক মুহূর্তের অসাবধানতা কীভাবে ধ্বংস ডেকে আনে। রাসেলের একা যাত্রা এখন শুরু হলো, কিন্তু আমাদের সকলের দায়িত্ব যেন সেই পথে একটু আলো ছড়ানো—নিরাপদ সড়কের জন্য, একটি ভালোবাসার পরিবারের জন্য।