ভোলাহাট উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ মনিরুজ্জামান এঁর ৪ মাস ১০ দিন কেমন কাটলো!

IMG_20251004_131914

এম. এস. আই শরীফ, ভোলাহাট (চাঁপাইনবাবগঞ্জ) প্রতিনিধি:

চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার ছোট্ট একটি উপজেলা ভোলাহাট। আর এ উপজেলাটি সার্বিক দিকদিয়েই উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি বললেই চলে। শিক্ষার হার বাড়লেও এলাকার মানুষের হৃদয়ের গ্লানি মুছেনি। আর এরই ধারাবাহিকতায় গোটা উপজেলার মানুষের গার্জিয়ান হিসেবে বছর দু’বছর পরপর বদলী হলেও “ভোলাহাট উপজেলা” র গার্জিয়ান হিসেবে আসেন উপজেলা নির্বাহী অফিসারগণ। সময়ের তালে তাল মিলিয়ে তথা সরকারী নিয়মনীতিকে মেনে চলে যান অন্যত্র পদন্নোতি পেয়ে আর না পেয়ে।

সরকারী নিয়মকে চিরসম্মান আর শ্রদ্ধা জানিয়ে গত ১৮ সেপ্টেম্বর’২৫ তারিখে উপজেলার সকলস্তরের মানুষের মনিকোঠায় জায়গা করে নেয়া সে-ই, সকলের সম্মানিত একজন পরিবারের প্রকৃত গার্জিয়ান হিসেবে ছিলেন, যার অফিসিয়াল কি আর আনঅফিশিয়াল হোক না কেনো তার দরজা ছিলো সবসময় খোলা, যার প্রতিফলন পেয়েছে উপজেলার সাধারণ সহজ-সরল, অসহায় গরীব মানুষেরা। তিনি সে-ই মানুষ যার কাজের পরিধি এমনই ছিলো যে, দুপুরের খাবারের কথা ভুলে যেতেন। তবুও তিনি ভোলাহাট উপজেলার চিরঅবহেলিত মানুষগুলোর প্রতি দয়ার সাগর হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি গত ১৮ সেপ্টেম্বর ‘২৫ তারিখে এলাকার মানুষের অশ্রুসিক্ত নয়নে বিদায় নিলেন, তিনি সকলের প্রিয়মুখ হিসেবে পরিগণিত ছিলেন-মোঃ মনিরুজ্জামান।

উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ মনিরুজ্জামান উল্লেখিত তারিখে ভোলাহাট উপজেলা থেকে বদলী হলে অতিরিক্ত দায়িত্বে নেন, পার্শ্ববর্তী উপজেলা গোমস্তাপুরের ইউএনও জাকির মুন্সি। সপ্তাহে দু’একদিন ভোলাহাট উপজেলায় কাজ করেন তিনি।

মোঃ মনিরুজ্জামান উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসেবে ছিলেন, একজন প্রকৃত প্রথমশ্রেণীর কর্মকর্তা। তিনি যেস্থানেই বদলীর হাতধরে যান না কেনো, সে উপজেলাটির ভাগ্যাকাশে উন্নয়নের জোয়াড়ের বন্যা বইতে থাকবে এলাকার সচেতন ব্যক্তির মুখে মুখে ধ্বনিত হবার সুর বইছে।

এলাকায় প্রিয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিত এ উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ মনিরুজ্জামান স্যারের নিজ ভাষায় লেখা থেকে এখানে উল্লেখঃ

প্রিয়_ভোলাহাটবাসী…

অফিসিয়ালি গত সপ্তাহে বিদায় নিলেও ব্যস্ততার কারণে কারও সাথে দেখা করা হয়ে উঠেনি। পরে গিয়ে আবার নতুন করে বিদায় নিলাম নৈসর্গিক ভালোবাসার এই ভোলাহাট থেকে। যখন এখানে আমাকে পদায়ন করা হয় দুরত্বের কারণে কিছুটা মন খারাপ হলেও মানিয়ে নিয়েছিলাম। বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ দেখতে ঘুরে বেড়িয়েছি ভোলাহাটের প্রতিটি কোনায় কোনায়। নিজের উপজেলা বা গ্রাম কে যতটুকু না চিনি তারথেকে বেশি চিনেছি এই ভোলাহাট উপজেলা কে। এই এলাকার নৈসর্গিক এবং আনটাচড প্রকৃতি মুগ্ধ করেছে সবসময়। যেখানে দূরাবস্থা দেখেছি, সংস্কার করার চেষ্টা করেছি। দীর্ঘদিন যাবৎ চলে আসা অনিয়মগুলোকে নিয়মের মধ্যে আনার চেষ্টা করেছি। কিছু ক্ষেত্রে সহজে হলেও অনেক জায়গায় কঠোর হতে হয়েছে। সরকারের প্রদত্ত সহায়তাগুলি প্রকৃত উপকারভোগীদের যাচাই বাছাই করে দিতে চেষ্টা করেছি। কোথাও যেন তাদের অর্থ দিতে না হয় সেজন্য বার বার সতর্ক করেছি। তারপরেও যারা দিয়েছিল তাদের টাকাগুলি আদায় করে অপরাধীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। বিভিন্ন পদ্ধতিতে তদন্ত করে নিজে কয়েকটা রাত জেগে মোটামুটি একটা সঠিক তালিকা কর‍তে পেরেছি। অনেকে টাকা ছাড়া কার্ড পেয়ে সামনে কেদেছে। পেয়েছি ভোলাহাটের মানুষের অকৃত্তিম ভালোবাসা যা আমার চাকরি জীবনের সবচেয়ে বড় সঞ্চয়।

বিনোদনের জন্য বিখ্যাত বজরাটেক এ গিয়েছি অসংখ্য বার, এমনকি বিদায়ের দিনে শেষ সময়টাতেও গিয়ে এর সৈন্দর্য্য সবচেয়ে বেশি উপভোগ করেছি। পরিকল্পনা করেছি বজরাটেক কে বিভিন্ন রুপে সাজানোর। পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে আর্কিটেকচার এ পড়ুয়া ভোলাহাটেরই এক স্টুডেন্ট কে দিয়ে ডিজাইন এর কাজ চলছিল। প্রায় ১২-১৩ লাখ টাকার উন্নয়ন প্রকল্প দিয়ে গেলাম বজরাটেকের জন্য, যার কাজ হয়তো পরবর্তী ইউএনও এর হাত ধরে দ্রুতই শুরু হবে। আম চত্ত্বরের জন্য কিছু বরাদ্দ রাখা হয়েছে। বিল ভাতিয়া বিল নিয়ে অনেক পরিকল্পনা ছিল। প্রায় ২ কিলোমিটার জুড়ে বিভিন্ন ফুল ও বনজ গাছ লাগানো এবং রাস্তাগুলো কিভাবে সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন করা যায় মাথায় ছিল। বরাদ্দ দিয়ে কাজও শুরু করলাম। জলাবদ্ধতা নিয়ে সুরানপুর ও মেডিকেল মোড়ের মানুষ খুব কষ্টে ছিল, যা সংস্কারের ফলে আশা করি আগামী কয়েক বছরে এই সমস্যা ভোলাহাটবাসীকে পোহাতে হবে না।

ফুটবল টুর্নামেন্ট নিয়ে বলতেই হয় কারণ এখানে নিজের সবচেয়ে মাধুর্য্য এবং ভালোবাসা ইনভেস্ট করতে হয়েছে। সাথে ছিল উপজেলার সর্বস্তরের মানুষ, কর্মকর্তাবৃন্দ, সাংবাদিক সহ অফিসের দক্ষ ও কর্মঠ স্টাফবৃন্দ। কিছু ত্রুটি ছাড়া বাকি সবকিছু খুব ভালোভাবে সম্পন্ন করতে পেরেছি। বিশেষ করে উপজেলার ফুটবলার ছেলেগুলোর সবাইকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি। তাদের জন্য অনেক কিছু করার ইচ্ছা ছিল। মিস করবো আমার টিমকে এবং আশা করি নার্সিং করলে খুব ভালো করবে সবাই।

সর্বোপরি বলতে চাই ভোলাহাট উপজেলার রাজনৈতিক সকল নেতৃবৃন্দ আমার সকল কাজে সহযোগিতা করেছে। আমার বদলির জন্য তাদের কেউ কোনভাবেই দায়ী নয় বরং বদলির কারণে তারা আমাকে ফোন দিয়ে থাকার অনুরোধ করেছেন। তাদের প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা। চার মাস দশ দিনের এই স্বল্প সময়ে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কারও সাথে জোরে কথা বলে থাকতে পারি, অজান্তে অন্যায় করে ফেললে বা কোন আচরণের মাধ্যমে কাউকে কষ্ট দিয়ে থাকলে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। আমার পরবর্তী স্টেশন, ঈশ্বরদী, পাবনা। সবার কাছে দোয়ার আবেদন রইলো যেন আমার ওপর অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারি।

ভোলাহাট থেকে চলে গেলেও উন্নয়ন কার্যক্রম যেন থমকে না যায় সেজন্য ভোলাহাট উপজেলার জন্য রেখে গেলাম প্রায় ১.৫ (দেড় কোটি) টাকার উন্নয়ন প্রকল্প যা বাস্তবায়ন হলে রাস্তা ঘাটের অবকাঠামোগত উন্নয়ন এর পাশাপাশি সৃষ্টি হবে অনেক মানুষের আয়ের সুযোগ। বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা হবে উপজেলাবাসীর।

পরবর্তীতে এখানে আসবো ভিন্ন পরিচয়ে যেখানে থাকবে না কোন দায়িত্বের ভার। আসবো শুধু ভোলাহাটের সৌন্দর্য উপভোগ কর‍তে। মনে থাকবে আমার ইউএনও হিসেবে প্রথম উপজেলা ভোলাহাটকে। মিস করবো এখানকার সহজ সরল মানুষ ও প্রকৃতিকে।

ছবিক্যাপশনঃ ভোলাহাটে মাত্র ৪ মাস ১০ দিনের চাকরীরত ইউএনও মোঃ মনিরুজ্জামান’র ছবি। পাশে-তার স্বল্পরসময়ে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজের ভিডিওসহ দৃশ্যপট।