স্বামীর লাশের চেয়েও ভারী ঋণের বোঝা
মো: আব্দুল আউয়াল খান। কেন্দুয়া (নেত্রকোনা)
‘আমার সব শেষ অইয়্যা গেছে। আমি কী কইরা ৬ লাখ টাকার ঋণ দেব? তিন মেয়েরে নিয়া কীভাবে চলব? আমি সরকারের কাছে আমার ঋণের টাকা পরিশোধ করে তিন মেয়েকে নিয়ে চলার ব্যবস্থা করে দেওয়ার অনুরোধ করতেছি। সরকার সহযোগিতা না করলে এই ঋণের যন্ত্রণায় আমি মরে যাব।’ গত শনিবার কেন্দুয়া উপজেলার মোজাফরপুর ইউনিয়নের মোজাফরপুর গ্রামে গিয়ে এমন আহাজারি করতে দেখা গেল খাইরুন্নেজ্জাকে। গত ১৮ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় ঢাকায় গুলিতে প্রাণ যায় তাঁর স্বামী আলী হোসেনের।
রাজধানীর উত্তরা আজমপুর এলাকায় রাস্তার পাশে বসে প্রতিদিন পান-সিগারেট বিক্রি করতেন আলী হোসেন (৪০)। স্ত্রী খাইরুন্নোচ্ছা অন্যের বাসায় করতেন ঝিয়ের কাজ। তাতে ভালোই চলছিল তারেরা সংসার। হঠাৎ কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় স্বামীকে হারিয়ে সবকিছু এলোমেলো হয়ে
গেল খাইরুন্নেচ্ছার।
গত শনিবার মোজাফরপুর গ্রামে কান্নাজড়িত কণ্ঠে খাইরুন্নেচ্ছা জানান,
ঘটনার দিন সকালে স্বামী আলী হোসেনকে নিয়ে পান্তাভাত খেয়ে যার যার কাজে চলে যান। দুপুর ২টার দিকে বাসায় ফেরেন খাইরুন্নেচ্ছা। স্বামীকে নিয়ে আজমপুর মুন্সি বাজার এলাকায় মাসে সাড়ে ৩ হাজার টাকায় ভাড়া বাসায় থাকতেন। ওই দিন একসঙ্গে দুপুরের খাবার খাবেন এই অপেক্ষায় বসে আছেন তিনি। কিন্তু দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত তাঁর স্বামী বাসায় না ফেরায় চিন্তায় পড়ে যান। পরে মোবাইল ফোনে বিষয়টি জানালে খোঁজাখুঁজি শুরু করেন স্বজনরা। অবশেষে সন্ধ্যার পর তাঁর লাশ পাওয়া যায় কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে। সেখান থেকে অ্যাম্বুলেন্সে করে লাশ নিয়ে বাড়িতে পৌঁছান রাত ৪টার দিকে। পরদিন সকালে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।
খাইরুন্নেছা জীবনের বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, তাদের তিন মেয়ে রয়েছে। তাঁর বড় মেয়ে সাদিয়া (১৪) মোজাফরপুর মহিলা মাদ্রাসায় পড়ে। মেজো মেয়ে মাহিবা (৬) প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ে। ছোট মেয়ে সাইবার (৩)। তিন মেয়েকে শাশুড়ির কাছে
তিন সন্তানের সঙ্গে নিহত আলী হোসেনের স্ত্রী খাইরুন্নেচ্ছা সমকাল
রেখে স্বামী আলী হোসেনকে নিয়ে ঢাকায় গিয়েছিলেন তিনি। ইচ্ছা ছিল দু’জনে কাজ করে ঋণ পরিশোধ করবেন। তিনি বলেন, আলী হোসেন গ্রাম্য মহাজনদের কাছ থেকে ৬ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। এর মধ্যে ৩ লাখ টাকার জন্য প্রতি মাসে সুদের ৩০ হাজার টাকা দিতে হয়েছে।
আলী হোসেনের ছোট ভাই আবু বক্কর বলেন, ‘ভাই যার কাছ থেকে ৩ লাখ টাকা নিয়েছিলেন তিনি লাভের টাকা অর্ধেক কমিয়ে প্রতি মাসে ১৫ হাজার টাকা দিতে বলেছেন। এই ৬ লাখ টাকা এখন কীভাবে পরিশোধ করবেন, কীভাবে দেবেন প্রতি মাসে লাভের টাকা, তা নিয়ে দিনরাত শুধু কাঁদছেন আর কাঁদছেন।’
কেন্দুয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইমদাদুল হক তালুকদার বলেন, ‘আমি ব্যস্ততার কারণে যেতে পারিনি। তবে বিনা পয়সায় আলী হোসেনের মেয়েদের লেখাপড়ার ব্যবস্থা করার জন্য বলে দিয়েছি। খুব তাড়াতাড়ি আলী হোসেনের স্ত্রীকে একটি বিধবা ভাতার ব্যবস্থা করে দেব। সে জন্য ইতোমধ্যে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহ করা হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘আলী হোসেনের স্ত্রী ঢাকায় কারও বাসায় ঝিয়ের কাজ করতেন। এখন যদি মনে করেন এলাকায় থাকবেন, সে ক্ষেত্রে আমরা তাঁকে সেলাই প্রশিক্ষণ ও সেলাই মেশিন দিয়ে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করব।’