ঘূর্ণিঝড় ‘রেমাল’ : খুলনায় উপকূলবাসীর ঘুম হারাম, রাত জেগে দুর্বল বাঁধ সংস্কার 

 

# প্রস্তুত ৬০৪ আশ্রয় কেন্দ্র

# ফায়ার সার্ভিসের বিভাগীয় মনিটরিং সেল, মাঠে ৩০ টিম 

মুহাম্মদ নূরুজ্জামান, খুলনা

ঘূর্ণিঝড় রেমাল আতংকে উপকূলের মানুষের খাওয়া-ঘুম হারাম হয়ে গেছে। দুশ্চিন্তায় নির্ঘুম রাত কাটিয়েছে অনেকে। রাত জেগে স্বেচ্ছাশ্রমে দুর্বল বেড়িবাঁধ সংস্কার করার চিত্র দেখা গেছে। সাইক্লোন সেন্টারগুলোতে ইতোমধ্যে মানুষ আসা শুরু করেছে। রাতে হালকা বাতাস ও গুম গুম আওয়া‌জে আতঙ্ক ছ‌ড়ি‌য়ে‌ছে। ভো‌রে বৃ‌ষ্টির দেখা‌ মে‌লে। পরবর্তীতে দিনভর হালকা ও মাঝারি বৃষ্টিপাত হয়। 

২৫ মে রাতে মোংলা বন্দরে ৭ নং বিপদ সংকেত ঘোষণার পরে খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা এলাকায় আতঙ্ক বাড়ে। সাথে সাথে এসব উপকূল এলাকায় ঘূর্ণিঝড় রেমাল মোকাবেলায় মানুষকে সচেতন করার লক্ষ্যে মাইকিং এর মাধ্যমে প্রচারণা চালানো হয়। মানুষদের আশ্রয় কেন্দ্রে যাওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়। এসব এলাকায় জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ব্যাপক প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে।

এদিকে, দক্ষিণ উপকূলীয় এলাকার অধিকাংশ বেড়িবাঁধই দুর্বল। যদিও পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, খুলনার দাকোপ, বটিয়াঘাটা, পাইকগাছা, কয়রার ৬৩০ কিলোমিটারের মধ্যে মাত্র ১০ কিলোমিটার বেড়িবাধ ঝুঁকিপূর্ণ। আর সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড-১ এর আওতায় বেড়িবাঁধ রয়েছে ৩৮০ কিলোমিটার। এরমধ্যে ৩০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ। বারবার বাঁধ ভাঙ্গায় উপকূলবাসী সংকেত পেলেই আতঙ্কে থাকেন।

খুলনার ও সাতক্ষীরা উপকূলীয় এলাকায় ২০০৯ সালের ২৫ মে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় আইলা। আইলার সেই ক্ষত কাটিয়ে ওঠার আগেই ২০১৩ সালের ১৬ মে মহাসেন, ২০১৫ সালের ৩০ জুলাই কোমেন, ২০১৬ সালের ২১ মে রোয়ানু, ২০১৭ সালের ৩০ মে মোরা, ২০১৯ সালের ৪ মে ফণী, একই বছরের ১০ নভেম্বর বুলবুল আঘাত হানে। ২০২০ সালের ২০ মে আম্পান, ২০২১ সালের ২৬ মে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় ইয়াস। ২০২২ সালের ১২ মে আসনি, এরপর একই বছরের ২৫ অক্টোবর সিত্রাং এবং সর্বশেষ ‘মোখা’ আঘাত হানে। এসব ঘূর্ণিঝড়ের সময় বেড়িবাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয় কয়রা, দাকোপ, আশাশুনি ও শ্যামনগর উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়ন। যার ক্ষত এখনো শুকায়নি। সর্বশেষ উপকূলে ঘূর্ণিঝড় রেমালের আঘাত হানার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

উপকূলীয় সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ইউনিয়নের বেড়িবাঁধের অনেক জায়গা দিয়ে চুইয়ে পানি ঢুকছে বলে জানা যায়। সুভদ্রাকাটি এলাকার একটি জরাজীর্ণ বাঁধ গভীর রাতে স্বেচ্ছাশ্রমে এলাকাবাসী মেরামত করেন। পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে সেখানে জিও ব্যাগের ব্যবস্থা করা হয়। আর এলাকাবাসী জিও ব্যাগে মাটি ভরে রাস্তা সংস্কার করেন। যে কোন সময় দুর্বল বেড়িবাঁধ নদী গর্ভে বিলীন হয়ে প্লাবিত হতে পারে বিস্তীর্ণ এলাকা। এমন আশংকা নিয়ে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে খুলনা জেলার কয়রা, দাকোপ, পাইকগাছা, সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর, আশাশুনির ও বাগেরহাট উপকূলের মানুষ।

কয়রা উপজেলার গোবরা গ্রামের বাঁধের পাশে বসবাসকারী আখতারুজ্জামান ও বিল্লাল হোসেন জানান, আইলার সময় ঘাঁটাখালি বাঁধ ভেঙ্গে যাওয়ায় তাদের বসতবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়। এরপরে প্রায় দুই মাস আশ্রয় কেন্দ্রে থাকেন। সেখান থেকে বাঁধের উপরে ঝুপড়ি বেঁধে বসবাস শুরু করেন। একপর্যায়ে জনপ্রতিনিধিদের কথায় বাঁধের স্লোবে পুনরায় ঘর তৈরি করে বসবাস করছেন। আইলার ১৫ বছর পরেও তারা নিজ ঠিকানায় ফিরতে পারেননি। সেখানে বাঁধের পাশে প্রায় শতাধিক পরিবার রয়েছে। তারা রেমাল ঝড়ের সংকেত পেয়ে আতঙ্কে রয়েছেন। নির্ঘুম রাত কাটিয়েছেন।

কয়রার দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোঃ আছের আলী মোড়ল জানান, তার ইউনিয়নের ঘড়িলাল থেকে চরামুখা খেয়াঘাট, খেয়াঘাট থেকে হলদিবুনিয়া পর্যন্ত বেশি ঝুঁর্কিপূর্ণ।

সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ সালাউদ্দিন জানান, আমাদের আওতায় বেড়িবাঁধ রয়েছে ৩৮০ কিলোমিটার। এরমধ্যে ৩০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ। তবে গাবুরায় মেগা প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। কিছু জায়গায় সমস্যা রয়েছে। তাৎক্ষনিকভাবে কোন সমস্যা হলে সে জন্য কাজ করার সুযোগ রয়েছে।

খুলনা পানি উন্নয়ন বোর্ড (বিভাগ-২) এর নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ আশরাফুল আলম ব‌লেন, আমার এরিয়ার মধ্যে ৬৩০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। এর মধ্যে ১০ কিলোমিটার ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে। এছাড়া তাৎক্ষণিক কোন সমস্যা হলে জরুরি ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ রয়েছে।

এদিকে, ঘূর্ণিঝড় ‘রেমাল’র ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে খুলনা উপকূলবর্তী তিনটি উপজেলায় প্রস্তুত রাখা হয়েছে ৬০৪টি আশ্রয় কেন্দ্র। এছাড়া ৩টি মুজিব কিল্লা ও ৫ সহস্রাধিক স্বেচ্ছাসেবক প্রস্তত রয়েছে। এসব আশ্রয় কেন্দ্রে ৩ লাখ ১৫ হাজার মানুষ থাকতে পারবে।

খুলনা জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, উপকূলবর্তী খুলনার তিনটি উপজেলা কয়রা, দাকোপ ও পাইকগাছার  সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিজ নিজ কর্মস্থলে থাকার জন্য বলা হয়েছে। সতর্ক থাকার জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদেরকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। বিপদ সংকেত জারি হলে তারা এলাকায় মাইকিংয়ের ব্যবস্থা করবেন। শুকনো খাবার, ওষুধ, ঢেউটিন ও নগদ টাকা প্রস্তত রাখা হয়েছে। প্রস্তত রয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ, ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ, নৌ বাহিনী, কোস্টগার্ড, পানি উন্নয়ন বোর্ড। প্রস্তুতিতে কোনো ঘাটতি নেই।

খুলনা জেলা প্রশাসক খন্দকার ইয়াসির আরেফীন জানান, ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষতি এড়াতে কয়রা, দাকোপ ও পাইকগাছা উপজেলায় ৫ হাজার ২৮০ জন স্বেচ্ছাসেবককে প্রস্তুত থাকতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এছাড়া ৬০৪টি সাইক্লোন শেল্টার প্রস্তুত রাখা হয়েছে। যাতে পরিস্থিতি অনুযায়ী ঝুঁকিপূর্ণ লোকজন সেখানে আশ্রয় নিতে পারেন। এসব সাইক্লোন শেল্টারে মোট ৩ লাখ ১৫ হাজার ১৮০ জন মানুষ আশ্রয় নিতে পারবে। এছাড়া ৩টি মুজিব কিল্লায় ৪৩০ জন মানুষ আশ্রয় ও ৫৬০টি গবাদি পশু রাখা যাবে। 

অপরদিকে, ঘূর্ণিঝড়-পূর্ব, ঘূর্ণিঝড় সময়কালীন এবং ঘূর্ণিঝড়-পরবর্তী কর্মতৎপরতা সমন্বয় করতে খোলা হয়েছে খুলনা ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স’র বিভাগীয় মনিটরিং সেল। খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটে কাজ করছে ফায়ার সার্ভিসের ৩০টিম। মাইকিং করে উপকূলীয় এলাকায় চালানো হচ্ছে সচেতনতামূলক প্রচারণা। খুলনা বিভাগীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষ এ বিষয়ে সার্বক্ষণিক নজরদারি করছে। রয়েছে স্পেশাল টিম। 

সার্বিকভাবে যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তুত রয়েছে ফায়ার সার্ভিস। দুর্যোগপ্রবণ এলাকার জনসাধারণকে সচেতন, সতর্ক ও সাবধান করছে দুর্যোগপ্রবণ এলাকার ফায়ার স্টেশনগুলো। উপকূলীয় এলাকাসমূহের সকল ফায়ার স্টেশনের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীর ছুটি বাতিল করে সবাইকে সতর্ক ডিউটিতে রাখা হয়েছে।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স খুলনার উপপরিচালক মামুন মাহমুদ বলেন, ঘূর্ণিঝড় রেমালে খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটের ৩০টি টিম শনিবার সকাল ৬টা থেকে কাজ শুরু করেছে। এরমধ্যে খুলনায় ১৪টি ফায়ার স্টেশন রয়েছে। যারমধ্যে একটি রিভার ফায়ার স্টেশন আছে। এছাড়া বাগেরহাটে ১০টি এবং সাতক্ষীরায় ৬টি ফায়ার স্টেশনের টিম কাজ করছে। টিমের সদস্যরা

মানুষকে সচেতন করার পাশাপাশি রেসকিউ, বিশুদ্ধ খাবার পানির ব্যবস্থা, নিরাপদে আশ্রয় কেন্দ্রে আনাসহ যাবতীয় কাজ করবে। জল ও স্থল উভয় পথে ফায়ার সার্ভিসের টিম এবং যাবতীয় সরঞ্জাম প্রস্তুত রাখা হয়েছে। খুলনা সদরদপ্তরে স্ট্যান্ডবাই রাখা হয়েছে ২০ সদস্যের স্পেশাল টিম। খোলা হয়েছে মনিটরিং সেল।
ফায়ার সার্ভিসের সূত্রে জানা গেছে, দুর্যোগপ্রবণ এলাকার জরুরি পরিস্থিতিতে প্রতি ফায়ার স্টেশনে ফায়ারফাইটিং টিম, সার্চ অ্যান্ড রেসকিউ টিম, প্রাথমিক চিকিৎসাকারী দল এবং ওয়াটার রেসকিউ টিম প্রস্তুত রাখা হয়েছে। প্রয়োজনীয় সংখ্যক অগ্নিনির্বাপণ ও উদ্ধার সরঞ্জামসহ অ্যাম্বুলেন্স, চেইন স’, হ্যান্ড স’, রোটারি রেসকিউ স’, স্প্রেডার, মেগাফোন, র‌্যামজ্যাক বা এয়ার লিফটিং ব্যাগ, ফাস্ট এইড বক্সসহ যাবতীয় সরঞ্জাম প্রস্তুত রাখা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়-পরবর্তী অনুসন্ধান ও উদ্ধারকাজসহ রাস্তাঘাট যান চলাচল উপযোগী করার কাজে ফায়ার সার্ভিস নিয়োজিত থাকবে। তাদের সাথে সহযোগিতা করবেন ফায়ার সার্ভিসের প্রশিক্ষিত ভলান্টিয়াররা। এসব এলাকায় জীবন ও মালামাল সুরক্ষা সংক্রান্ত যেকোনো কাজে দিবা-রাত্রি ২৪ ঘণ্টা ফায়ার সার্ভিসের সেবা গ্রহণ করা যাবে। সব আশ্রয়কেন্দ্রের পাশাপাশি প্রয়োজনে উপকূলবর্তী ফায়ার স্টেশনগুলোতেও সাধারণ জনগণ আশ্রয় নিতে পারবেন।

এই সূত্র জানান, ফায়ার সার্ভিসের মনিটরিং সেল, বিভাগীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষ সার্বক্ষনিক তথ্য সংগ্রহে নিয়োজিত থাকবে। যেকোনো জরুরি প্রয়োজনে সেবা গ্রহণের জন্য ফায়ার সার্ভিসের নিকটবর্তী ফায়ার স্টেশন, বিভাগীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষ, কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষের হটলাইন নম্বর ১৬১৬৩ অথবা খুলনা বিভাগীয় মনিটরিং সেল-এর জরুরি মোবাইল নম্বর ০১৭৩৩০৬২২০৯-এ ফোন করার জন্য সবাইকে অনুরোধ জানানো হয়েছে। এছাড়া জরুরী প্রয়োজনে ১০২ এবং ৯৯৯ হটলাইনে কল করে তথ্য জানানো যাবে।