খুলনার রূপসায় মাহিন্দ্রা মালিক সমিতির নামে চালকদের কো‌টি টাকা চাঁদা আদায়

খুলনার রূপসায় মাহিন্দ্রা মালিক সমিতির নামে চালকদের কো‌টি টাকা চাঁদা আদায়

 মাসিক চাঁদা দিতে হয় সা‌র্জেন্ট, থানা ও হাইও‌য়ে পু‌লি‌শ‌কে!
খুলনার রূপসায় মাহিন্দ্রা মালিক সমিতির নামে চালকদের 

থেকে প্রায় কো‌টি টাকা চাঁদা আদায়

# জেলা প্রশাসক বরাবর সহ বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ

খুলনা ব্যুরো

খুলনার রূপসা উপ‌জেলায় মাহিন্দ্রা মালিক সমিতির না‌মে চালক‌দের থে‌কে বছ‌রে প্রায় এক কো‌টি টাকা চাঁদা আদা‌য়ের অ‌ভি‌যোগ উঠেছে। মা‌সিক ও দৈ‌নিক ভি‌ত্তি‌তে রূপসা থে‌কে ছে‌ড়ে যাওয়া বি‌ভিন্ন রু‌টের প্রায় পাঁচশ’ মা‌হিন্দ্রা চালকের কাছ থে‌কে এই চাঁদা আদায় করা হয়। আর এ চাঁদার অ‌ধিকাংশ টাকাই পু‌লিশ-প্রশাসনের প‌কে‌টে যায় ব‌লে স‌মি‌তির নেতৃবৃন্দ সূ‌ত্রে জানা যায়। ত‌বে চাঁদা নেওয়ার বিষয়‌টি অস্বীকার ক‌রে‌ছেন রূপসা থানা ও কাটাখালী হাইও‌য়ে থানার অ‌ফিসার ইনচার্জদ্বয়।  

রূপসা থে‌কে বি‌ভিন্ন রু‌টে চলাচলকারী বেশ ক‌য়েকজন মা‌হিন্দ্রা মা‌লিক ও চালকের সা‌থে কথা ব‌লে জানা যায়, রূপসা উপজেলা হ‌তে বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী মাহিন্দ্রার শ্রমিকদের নিকট থে‌কে প্রতি মাসে থানা পুলিশ, হাইওয়ে পুলিশ এবং জেলা ট্রাফিক পুলিশের নামে চাঁদার টাকা আদায় করেন সমিতির ষ্ট্যাটার মো. ফজলুর রহমান, আবু তা‌লেব, আকাশ, হাসান ও হারুণ। প্রতিদিন সন্ধ্যার পর রূপসা থেকে হাইও‌য়ের সড়ক দি‌য়ে কাটাখালি রু‌টে চলাচল করে ৫০টি মাহিন্দ্রা। যার প্রতি‌টি গাড়ী থেকে মাসিক হি‌সে‌বে পাঁচ শত টাকা চাঁদা দি‌তে হয়। এই রুট থে‌কে প্রতিমাসে ২৫ হাজার টাকা আ‌সে। রূপসা টু ভান্ডারকোর্ট রুটে চলে ৬০ টি মাহিন্দ্রা। এদের প্রত্যেক গাড়ী থেকে মাসিক চাঁদা আদায় করা হয় দুইশ’ টাকা। এই রু‌টে মা‌সে আদায় হয় ১২ হাজার টাকা। রূপসা টু ফকিরহাট রুটে চলে দুই শত গাড়ী। এদের কাছ থেকে প্রতি মাসে আদায় করা হয় গাড়ী প্রতি ১৫০ টাকা। এই রু‌টে মা‌সে আদায় করা হয় ৩০ হাজার টাকা। এছাড়া ফকিরহাট থে‌কে রূপসায় আসা ১২০ টি মাহিন্দ্র গাড়ি থেকে প্রতি মাসে এক শত টাকা করে ১২ হাজার টাকা আদায় করা হয়। সর্ব‌মোট মাসিক চাঁদা আদায় হয় ৭৯ হাজার টাকা। 

এছাড়া মা‌সিক চাঁদার পাশাপা‌শি দৈনিক গাড়ী প্রতি ৫০ টাকা হা‌রে চাঁদা নেয়া হয়। সে হিসেবে ৪৩০ টি মা‌হিন্দ্রা থে‌কে দৈনিক ২১ হাজার ৫’শ টাকা আদায় করা হয়। যা থে‌কে মা‌সে আদায় হয় ৬ লাখ ৪৫ হাজার টাকা। দৈ‌নিক থে‌কে প্রতি মাসে ৬ লাখ ৪৫ হাজার টাকা ও মা‌সিক থে‌কে ৭৯ হাজার টাকা মি‌লে প্রতি মা‌সে সর্ব‌মোট ৭ লাখ ২৪ হাজার টাকা আদায় হয়। আর বছ‌রে আদায় হয় ৮৬ লাখ ৮৮ হাজার টাকা।

একা‌ধিক শ্রমি‌কের অ‌ভি‌যোগ র‌য়ে‌ছে, আদায়কৃত টাকা থে‌কে পু‌লিশ-প্রশাসন‌সহ স‌মি‌তির অন‌্যান‌্য কা‌জে কিছু টাকা ব‌্যয় ক‌রে বাকী সব আত্মসাৎ করেন মাহিন্দ্র মা‌লিক স‌মি‌তির নেতৃবৃন্দ। পবিত্র মাহে রমজান মাস উপলক্ষে গাড়ীর যাত্রী কম হওয়ার কারণে সারাদিনে যে আয় হয় তা দিয়ে ভুক্তভোগী শ্রমিকদের জীবন-জীবিকা চালানো খুব কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। যে কারণে সাধারণ শ্রমিকরা মালিক সমিতির নেতৃবৃন্দদের কাছে রোজার মাসে অ‌র্ধেক চাঁদা তোলার দাবি জানা‌লেও তারা আম‌লে নেননি। মা‌লিক সমি‌তির নেতৃবৃন্দ সেই দাবি‌কে উপেক্ষা করে রোজার মাস উপলক্ষে কিভাবে আরো বেশি চাঁদা নেওয়া যায় সেই তালবাহানা অব্যহত রেখেছেন।

নাম প্রকা‌শে অ‌নিচ্ছুক রূপসা কাটাখালী রু‌টের এক চালক জানান, পু‌লিশ-প্রশাসন‌কে ম‌্যা‌নেজ করার না‌মে আমা‌দের থে‌কে টাকা নেয়া হয়। জী‌বিকার তা‌গি‌দে ভাড়া নি‌য়ে মা‌হিন্দ্রা চালাই। প্রতি‌দিন যা আয় হয় তা থে‌কে মাহিন্দ্রা ভাড়া দেওয়ার প‌রে আর তেমন থা‌কে না। এরপ‌রেও ক‌ষ্টে অ‌র্জিত টাকা থে‌কে প্রতি‌দিন চাঁদা দি‌তে হয়। আমরা নি‌রিহ মানুষ। চাঁদা না দি‌লে নানা সমস‌্যার সম্মুখীন হ‌তে হয়।

স‌মি‌তির নেতাদের চাঁদাবাজীর কবল থেকে মু‌ক্তি পে‌তে ক‌য়েকজন মা‌হিন্দ্রা চালক এক‌ত্রিত হ‌য়ে (গত ২৮ মার্চ) খুলনা জেলা প্রশাসক বরাবর লি‌খিত আবেদন ক‌রে‌ছেন। এছাড়া বিভিন্ন দপ্তরে ডাক বিভাগের মাধ্যমে লিখিত আবেদনের অনু‌লি‌পিও পা‌ঠি‌য়ে‌ছেন।

মালিক সমিতির চাঁদা আদায়কারী মো. ফজলুর রহমান জানান, রূপসা থে‌কে কাটাখালী রু‌টে গা‌ড়ি প্রতি মা‌সে দুইশ থে‌কে তিনশ’ টাকা তোলা হয়। অন‌্যান‌্য রু‌টের মাসিক চাঁদা সম্প‌র্কে তি‌নি বল‌তে পা‌রেন না। আর মা‌সিক চাঁদার টাকা হাইও‌য়ে পু‌লিশ, সা‌র্জেন্ট ও থানায় দেয়া হয়। এছাড়া দৈ‌নিক উ‌ত্তোলনকৃত টাকা থে‌কে তা‌দের নি‌জে‌দের বেতন নেন।

রূপসা মাহিন্দ্রা মালিক সমিতির সভাপতি মো. নাজির শেখ বলেন, প্রতি‌দিন গা‌ড়ি প্রতি ৫০ টাকা ক‌রে নেয়া হ‌লেও ২০ টাকা শ্রমিক স‌মি‌তি‌কে দেয়া হয়, ২০ টাকা আমা‌দের স‌মি‌তির (মা‌লিক) ফা‌ন্ডে জমা করা হয় আর ১০ টাকা স্ট‌্যাটার‌দের দেয়া হয়। আর মা‌সিক টাকা নেয় হয়, ত‌বে এত বে‌শি না। 

তি‌নি আরও ব‌লেন, পূ‌র্বের ক‌মি‌টির ধারাবা‌হিকতায় আমরা চাঁদা নি‌চ্ছি। আমা‌দের আ‌গে যারা দায়িত্ব পালন করে‌ছেন তারা অ‌নেক বে‌শি নিত। আমরা তা‌দের তুলনায় কম নি‌চ্ছি।

এই টাকা কি কা‌জে ব‌্যয় ক‌রেন জান‌তে চাই‌লে তি‌নি ব‌লেন, মহাসড়‌কে মা‌হিন্দ্রা চলাচল নি‌ষেধ। এছাড়া অ‌নে‌কের কোন বৈধ কাগজপত্র নেই। ফ‌লে সার্জন, থানা ও হাইও‌য়ে পু‌লিশদের ম‌্যা‌নেজ করার পাশাপা‌শি বি‌ভিন্ন সামা‌জিক কা‌জে অনুদান এবং সংগঠ‌নের বি‌ভিন্ন কা‌জে প্রায় সব টাকা ব‌্যয় হ‌য়ে যায়। 

এছাড়া কখনও কোন দুর্ঘটনা ঘট‌লে তখন ঝা‌মেলা মেটা‌তেও অ‌নেক টাকা ব‌্যয় হয়। 

রূপসা মা‌হিন্দ্রা শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপ‌তি মোঃ ম‌ফিজুল ইসলাম জানান, শ্রমিক সংগঠ‌নের ২০ টাকা থে‌কে পাঁচ টাকা শ্রমিক‌দের কল‌্যাণ ফান্ডে, পাঁচ টাকা গাড়ী রাখার জায়গার জন‌্য ও বাকী ১০ টাকা ‌সংগঠ‌নের ফা‌ন্ডে জমা রা‌খেন। সংগঠ‌নের জমাকৃত টাকা থে‌কে বি‌ভিন্ন সামা‌জিক কা‌জে অনুদান, কর্মচারী‌দের বেতন, নেতা‌দের সম্মানীসহ সংগঠ‌নের বি‌ভিন্ন খরচ বাবদ ব‌্যয় হয়।

তি‌নি আরও ব‌লেন, চাঁদা কমা‌নোর বিষ‌য়ে ক‌য়েকজন শ্রমিক কিছু‌দিন আ‌গে আমা‌র কা‌ছে ব‌লে‌ছিল। ত‌বে মা‌লিক স‌মি‌তি য‌দি না মা‌নেন তাহ‌লে আমরা কি কর‌বো।

উ‌নি মা‌সিক চাঁদা দেওয়ার সত‌্যতা স্বীকার ক‌রে ব‌লেন,  মা‌সিক চাঁদা নেয়া হয়। ত‌বে কত নেয়া‌ হয় আর কোথায় কি ক‌রেন এটা মা‌লিক সমি‌তি জা‌নেন। 

কাটাখালী হাইও‌য়ে থানার অ‌ফিসার ইনচার্জ মোঃ মিজানুর রহমান চাঁদা নেওয়ার বিষ‌য় অস্বীকার ক‌রে ব‌লেন, আমরা কোন মা‌সিক চাঁদা নেই না। হাইও‌য়ে‌ সড়‌কে থ্রি হুইলার অ‌বৈধ। ত‌বে মা‌ঝেম‌ধ্যে সব জায়গায় চল‌ছে। আমরা ধ‌রতে‌ছি, মামলা দি‌চ্ছি। 

রূপসা থানার অ‌ফিসার ইনচার্জ মোঃ শওকত ক‌বির ব‌লেন, থানায় কোন চাঁদার টাকা নেওয়া হয়না। থানা পু‌লি‌শের কেউ য‌দি চাঁদা তো‌লে কিংবা নেন তাহ‌লে শ্রমিকরা আমা‌দের কা‌ছে এ‌সে অ‌ভি‌যোগ দি‌লে ব‌্যবস্থা নেব। আমা‌দের কা‌ছে তারা কেন আ‌সে না ? 

যে‌হেতু ডি‌সি বরাবর অ‌ভি‌যোগ ক‌রে‌ছেন, তি‌নি তদন্ত ক‌রে দেখ‌বেন। য‌দি আমা‌দের কোন অপরা‌ধের প্রমাণ পান তাহ‌লে ব‌্যবস্থা নে‌বেন।

খুলনা জেলার অ‌তি‌রিক্ত পু‌লিশ সুপার (ট্রা‌ফিক) এস এম আল-বেরুনী ব‌লেন, চাঁদা নেওয়ার বিষ‌য়ে আমা‌দের জানা নেই। এই প্রথম শুনলাম। আমা‌দের কা‌রো বিরু‌দ্ধে লি‌খিত অ‌ভি‌যোগ পে‌লে তদন্ত সা‌পে‌ক্ষে ব্যবস্থা নেয়া হ‌বে।

###