খুলনায় মীমকে নিয়ে বিশেষপোস্টার : সমালোচনার ঝড়
# সম্মতি থাকার দাবি করলেও অভিভাবকের অস্বীকার
# মেডিকেলে ভর্তি বাণিজ্যের অসম প্রতিযোগিতা
# বাণিজ্যিক স্বার্থে মেধাবী শিক্ষার্থীদের ব্যবহার
# সরকারি নির্দেশনাও মানেনি ডিএমসি ও মেডিএইড কোচিং
মুহাম্মদ নূরুজ্জামান, খুলনা :
মেডিকেল কলেজে ভর্তিকে কেন্দ্র করে থেমে নেই কোচিং সেন্টারগুলোর বাণিজ্যিক প্রচারণা। প্রতি বছরই তারা ভর্তি বাণিজ্যের অসম প্রতিযোগিতায় নামেন। এমনকি শুধুমাত্র বাণিজ্যিক স্বার্থে মেধাবী শিক্ষার্থীদেরও ব্যবহার করতে দ্বিধা করেন না। এমনই ঘটনার চিত্র এবার খুলনায় দৃশ্যমান। যা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছেন কথিত কোচিং ব্যবসায়ীরা। আর যাতে ব্যবহার করা হয়েছে মেডিকেলে দু’ বছর আগের দেশসেরা শিক্ষার্থী মীমকে।
তবে পোস্টার তৈরিতে অনুমতি ছিল বলে ‘ডিএমসি স্কলার কোচিং সেন্টার’র সিনিয়র শিক্ষক পরিচয়ে মির্জা সাইফুর রহমান দাবি করলেও শিক্ষার্থী সুমাইয়া মোসলেম মীমের বাবা কলেজ শিক্ষক মোসলেম উদ্দীন তা অস্বীকার করেছেন। বরং পোস্টারে তাদের মোবাইল নম্বরও ব্যবহার করায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন তিনি।
যদিও এর আগেই ডিএমসি স্কলার, উন্মেষ, রেটিনা ও মেডিকো’র মতো কোচিং সেন্টারগুলো দু’ বছর আগে মেডিকেলে প্রথম হওয়া খুলনার মেয়ে সুমাইয়া মোসলেম মীমকে নিয়ে রীতিমত কাড়াকাড়ি শুরু করে। চারটি কোচিং সেন্টারই মীমকে নিজেদের শিক্ষার্থী বলে দাবি করে। তবে এবার এক শিক্ষক দু’ বছর আগে হওয়া সেরা মীমের নিজ হাতে লেখা একটি চিঠি দিয়ে তৈরি পোস্টার সেঁটে গোটা নগরী ছেঁয়ে ফেলেছেন। আর বিশেষ এই পোস্টার নিয়ে তৈরি হয়েছে সমালোচনার ঝড়।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সম্প্রতি নগরীর বিভিন্ন এলাকার দেয়ালে দেয়ালে খুলনার ‘ডিএমসি স্কলার কোচিং সেন্টার’র সিনিয়র শিক্ষক পরিচয়ে ‘সাইফুর’ নামে বড় অক্ষরে লেখা একটি বিশাল সাইজের পোষ্টার লাগানো হয়েছে। যাতে নগরীর রয়েল মোড় সংলগ্ন লাজ ফার্মা ভবনের তৃতীয় তলার ঠিকানা রয়েছে।
পোস্টারটিতে মির্জা সাইফুর রহমান ও সুমাইয়া মোসলেম মীমকে একসঙ্গে ফুলের তোড়া হাতে দেখা যায়। এই পোস্টারে ২০২২ সালে মেডিকেলে উত্তীর্ণ (৫৯ তম) অর্পণ সাহা, ১২৩ তম অর্পিতা বিশ^াস ও ১৭১ তম লামিম আনসারি রাদ’র সঙ্গেও ফুলের তোড়া নিয়ে মির্জা সাইফুর রহমানকে দেখা যায়। এছাড়া তাতে ঢাকার চার মেডিকেলে ১৭জনসহ সর্বমোট ৭২ জনের চান্স!!! মর্মে লেখা রয়েছে। তবে পোস্টারটিতে অন্য কোন মেধাবী শিক্ষার্থীরর নিজ হস্তে লিখিত পত্র বা তাদের মা-বাবা’র মোবাইল নম্বর দেওয়া না থাকলেও সেখানে মীমের স্বাক্ষরিত হস্তলেখা সম্বলিত একটি পত্র স্থান পেয়েছে।
যার ভাষা পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে ধরা হলো : ‘আমি সুমাইয়া মোসলেম মীম। প্রাক্তন সরকারি মজিদ মেমোরিয়াল সিটি কলেজ, খুলনা। এ বছর ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে জাতীয় মেধায় প্রথম স্থান অধিকার করেছি। প্রথমেই মহান আল্লাহ তায়ালার প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা। এরপরেই আমার আব্বু, আম্মু, আপু, আমার সকল শিক্ষক ও শুভানুধ্যায়ীদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। যারা সবসময় আমাকে উৎসাহ দিয়েছেন। ভর্তিযুদ্ধের এই সময়টাতে আমি পুরোটা সময় পাশে পেয়েছি ডিএমসি স্কলার পরিবারকে। বইয়ের অতিরিক্ত তথ্য ও প্রশ্ন অনুশীলনের জন্য আমি ডা. সিয়াম ভাইয়ার মাস্টার বুক ও মেডি থেরাপি এর সহযোগিতা নিয়েছি। ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতির সময়ে বাসায় মেন্টর হিসেবে ছিলেন মির্জা সাইফুর রহমান ভাইয়া। তিনি আমাকে সকল বিষয় দেখানোর পাশাপাশি আমার ইংরেজির দুর্বলতা কাটাতে অনেক সহায়তা করেছেন। এই কঠিন সময়ে পাশে থাকার জন্য ডিএমসি স্কলার পরিবার ও সাইফুর রহমান ভাইয়াকে অশেষ ধন্যবাদ। তাদের জন্য রইল শুভ কামনা। পোস্টারের নিচে লেখা-সুমাইয়া মোসলেম মীম, জাতীয় মেধায় প্রথম, মোবাইল
০১৭২৯-৯৯৫৬২০, ০১৭২৯-৩০৬৯১৫।
এদিকে, একজন শিক্ষার্থীর কাছ থেকে লিখিত নিয়ে সেটি আবার প্রকাশ্যে পোষ্টার আকারে দেয়ালে দেয়ালে লাগানোর বিষয়টি দেখে অনেকেই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। বিশেষ করে শুধুমাত্র শিক্ষার্থী টানতে এবং নিজেদের জাহির করতে এ ধরণের প্রচারণাকে কোচিং ব্যবসায়ীদের এক ধরণের নোংরামি বলেও মন্তব্য করেন অনেকেই।
পোস্টার ছাপিয়ে নগরীর দেওয়ালে দেওয়ালে লাগানোর বিষয়টি অকপটে স্বীকার করেছেন ‘ডিএমসি স্কলার কোচিং সেন্টার’র সিনিয়র শিক্ষক পরিচয়ে মির্জা সাইফুর রহমান। কোচিং থেকে নয়, নিজ অর্থ ব্যয়েই তিনি পোস্টার ছেপেছেন বলেও জানিয়েছেন।
দাবি করেছেন, এতে মীমের মা-বাবা’র সম্মতি ছিল। তবে প্রথমে লিফলেট তৈরির কথা থাকলেও পরে পোস্টারের চিন্তা মাথায় আসায় তা ছাপানো হয়। শিক্ষার্থী’র লিখিত দলিল কেন পোস্টার হলো এবং তাতে তার মা-বাবা’র মোবাইল নম্বরই দেওয়া কেন- এ প্রশ্নের সন্তোষজনক কোন জবাব দিতে পারেননি সাইফুর। তবে তিনি একটি মেডিকেল ভর্তি কোচিং’র সিনিয়র শিক্ষক পরিচয় দিলেও নিজে এখনও চিকিৎক হিসেবে প্যাডে নাম লেখাতে পারেননি বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে শিক্ষার্থী সুমাইয়া মোসলেম মীমের বাবা কলেজ শিক্ষক মোসলেম উদ্দীন সাইফুর’র এ ধরণের পোস্টার ছাপানোর কথা জানেন-ই না বলে জানান। বরং পোস্টারে তার মেয়ের হাতের লেখা কপি এবং নিজের ও তার স্ত্রী’র মোবাইল নম্বর ব্যবহার করায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। বলেন, সাইফুর তার মেয়েকে বাসায় পড়িয়েছেন। আর মীম দেশসেরা হলে বিভিন্ন কোচিং সেন্টার তাকে তাদের শিক্ষার্থী বলে দাবি করায় ডিএমসি স্কলার কোচিং’র সিয়ামকে মীম একটি লিখিত দেন। কিন্তু তা দিয়ে এভাবে পোস্টার করার কোন কথা ছিল না। এটি ঠিক হয়নি বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
সরকারি নির্দেশনাও মানেনি খুলনার ডিএমসি ও মেডিএইড কোচিং :
এদিকে, সরকারি নির্দেশনা অমান্য করে কোচিং খোলা রাখায় খুলনার মেডিকেল ভর্তি কোচিং মেডিএইড ও ডিএমসি স্কলারের অফিস বন্ধ করে সিলগালা করে দিয়েছে জেলা প্রশাসন। গত ১৬ জানুয়ারি খুলনা জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালিয়ে কোচিং দুটিতে তালা ঝুলিয়ে দেয়। এ অভিযান পরিচালনা করেন জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আবদুল্লাহ আল ইমরান ও মহেশ্বর মন্ডল।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে এমবিবিএস/বিডিএস ভর্তি পরীক্ষা সুষ্ঠুভাবে গ্রহণের লক্ষ্যে গত ৯ জানুয়ারি থেকে ১০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মেডিকেল ভর্তি কোচিং সেন্টার বন্ধ রাখতে খুলনা মহানগরীর মেডিকেল ভর্তি কোচিং সেন্টারসমূহে অভিযান পরিচালনা করা হয়। অভিযানকালে সরকারি নির্দেশনা মোতাবেক রেটিনা মেডিকেল কোচিং, মেডিকো মেডিকেল কোচিং ও উন্মেষ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল ভর্তি কেয়ার বন্ধ পাওয়া যায়। তবে নির্দেশনা অমান্য করে কোচিং খোলা রাখায় মেডিএইড ও ডিএমসি স্কলার মেডিকেল কোচিং বন্ধের নির্দেশ প্রদান করা হয় এবং প্রতিষ্ঠান দুটিই সিলগালা করা হয়।
খুলনা জেলা প্রশাসক খন্দকার ইয়াসির আরেফীন বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এমবিবিএস/বিডিএস ভর্তি পরীক্ষা সুষ্ঠুভাবে গ্রহণের লক্ষ্যে গত ৯ জানুয়ারি থেকে ১০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সকল মেডিকেল কোচিং অনলাইন ও অফলাইন বন্ধ রাখার নির্দেশনা ছিল। কিন্তু নির্দেশনা অমান্য করায় অভিযান চালিয়ে দুটি প্রতিষ্ঠান সিলগালা করা হয়।
জানা গেছে, ডিএমসি স্কলার মেডিকেল কোচিং সেন্টারটির মূল মালিক হচ্ছেন হাদিউর রহমান সিয়াম। তবে মালিক হলেও তিনি ‘উপদেষ্টা’ পরিচয়ে নগরীতে পোষ্টারিং করেছেন। পরিচালনায় সঙ্গে আরও কয়েকজনকে নিয়েছেন। ডা. সিয়ামের গ্রামের বাড়ি যশোরের কেশবপুর। বাবা-হাবিবুর রহমান গ্রাম্য চিকিৎসক। মা গৃহিনী, ৩ বোন ও ১ ভাইয়ের (৪ ভাই-বোন) মধ্যে তিনি তৃতীয়। কেশবপুর স্কুল ও কেশবপুর কলেজ থেকে লেখা পড়া শেষ করে ২০১২ সালে তিনি তারিমকান্ডে বিতর্কিত খুলনার থ্রি-ডক্টরস মেডিকেল কোচিং সেন্টারে ভর্তি হন। সেখানে কোচিং করে মেডিকেল পরীক্ষায় জাতীয় মেধায় ৪র্থ স্থান অর্জন করে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। সেখানে এফসিপিএস এবং লাস্ট পার্ট খুলনা মেডিকেলে সম্পন্ন করেন। পরবর্তীতে ৩৯ তম বিসিএস ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়ে প্রথমে কেশবপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, পরবর্তীতে ঝিকরগাছা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মেডিকেল অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। আর বর্তমানে সহকারী মেডিকেল অফিসার হিসেবে তিনি খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কর্মরত রয়েছেন। এর আগে ২০১৫ সাল থেকে ডিএমসি স্কলার মেডিকেল কোচিং খুলে কোচিং বাণিজ্য শুরু করেন।
প্রসঙ্গত, মেডিকেলে ভর্তির প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে দেশব্যাপী আলোচিত কোচিং সেন্টার ‘থ্রি ডক্টরস’র খুলনার পরিচালক ডা. ইউনুস খাঁন তারিমকে সম্প্রতি গ্রেফতার করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি। খুলনায় প্রশ্নপত্র ফাঁস সিন্ডিকেট’র খোঁজে এসে সিআইডি ডা. তারিমের আরও চার সহযোগিকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারকৃত অপর চারজন হচ্ছেন- ডা. লুইস সৌরভ সরকার, ডা. নাজিয়া মাহজাবিন তিশা, ডা. শর্মিষ্ঠা মন্ডল ও ডা. মুসতাসিন হাসান লামিয়া।