খুলনার সড়কে প্রতি মাসে অর্ধকোটি টাকা চাঁদাবাজি

অর্ধকোটি টাকা চাঁদাবাজি

# ১৪ পয়েন্টে চাঁদা আদায়
# পরিবহন সেক্টর 

মুহাম্মদ নূরুজ্জামান,
খুলনা নগরীতে ইজিবাইক, সিএনজি ও থ্রিহুইলার চালকরা চাঁদার চাপে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন। সিএনজি ও থ্রি হুইলার ৯টি পয়েন্টে এবং ৫টি পয়েন্টে ইজিবাইক চালকদের চাঁদা দিতে হচ্ছে। মাসে প্রায় অর্ধকোটি টাকার চাঁদাবাজি হচ্ছে। ইউনিয়নের ছত্রছায়ায় খুলনা মহানগর জাতীয় শ্রমিক লীগের প্রভাবশালী তিন নেতা এই চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করছে। চাঁদা না দিলে হুমকি ও মারধরের ঘটনাও ঘটছে। তাদের নিয়োগ দেওয়া স্ট্যাটার নামধারীরা চাঁদার এ অর্থ সংগ্রহ করছেন।
খুলনার রূপসা ঘাট থেকে ফুলতলা বাজার পর্যন্ত ৩২ কিলোমিটার সড়কের ৯টি পয়েন্টে প্রতিদিন চাঁদা দিতে হচ্ছে থ্রি হুইলার ও সিএনজি চালকদের। চালকপ্রতি দৈনিক ৭০ থেকে ৮০ টাকা পর্যন্ত এবং প্রতি মাসে ১০০ টাকা হারে চাঁদা দিতে হয় প্রতিটি চালককে।
খুলনা নগরীতে আগে রূপসা থেকে ফুলতলা রুটে প্রতি ১০ মিনিট অন্তর নগর পরিবহন সেবা চালু ছিল। কিন্তু ২০১৮ সালে নগর পরিবহন সেবা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তিন চাকার এই যানগুলোই একমাত্র বিকল্প খুলনাবাসীর। এদিকে বিআরটিএর তথ্য অনুযায়ী, খুলনা নগরে নিবন্ধিত থ্রি হুইলার ও অটোরিকশার সংখ্যা ২ হাজার ৫৯০টি। এর মধ্যে সাতটি ছাড়া বাকিগুলো ফিটনেস ও নিবন্ধন নবায়ন করা। অর্থাৎ সব গাড়িই সড়কে চলাচল করছে। এ ছাড়া বিআরটিএ বা সিটি করপোরেশন কারও কাছেই নিবন্ধনহীন সিএনজি, থ্রি হুইলার এবং ইজিবাইকের কোনো সঠিক হিসাব নেই। তবে ইউনিয়নগুলো তথ্য অনুযায়ী, সড়কে চলে মাত্র ১ হাজার ৬০০ থ্রি হুইলার ও অটোরিকশা চলাচল করে।
সরেজমিন দেখা গেছে, নগরীর ডাকবাংলো মোড় ও দৌলতপুর স্ট্যান্ডকেন্দ্রিক দুটি শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা চাঁদার বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করেন। তাদের নির্ধারিত ব্যক্তিরাই ৯টি মোড়ে প্রকাশ্যেই চাঁদা তোলেন। প্রতি মাসে আদায় করা হয় প্রায় ৩৭ লাখ ৬০ হাজার টাকা।
ফুলতলা থেকে আরেকটি থ্রি হইলারে ফেরার পথে দেখা গেল, ফুলতলা বাজার, শিরোমনি বাজার, ফুলবাড়িগেট স্ট্যান্ড, রেলিগেট, দৌলতপুর, নতুন রাস্তা মোড়, পাওয়ার হাউস মোড়, ডাকবাংলো স্ট্যান্ড এবং রূপসা ঘাটে টাকা দেওয়া বাধ্যতামূলক। এর বাইরে ইস্টার্ন গেট ও পিটিআই মোড়েও মাঝে মধ্যে চাঁদা নেওয়ার অভিযোগ আছে। এর মধ্যে ফুলতলায় ১০ টাকা, শিরোমনি ১০ টাকা, নতুন রাস্তা মোড় ১০ টাকা, ডাকবাংলো ১০ টাকাসহ প্রত্যেক চালককে সব মিলে ৭০ থেকে ৮০ টাকা চাঁদা দিতে হয়। প্রতিদিন এই ৯টি পয়েন্টে এ অর্থ আদায় করা হয়।
খুলনায় তিনটি ইউনিয়নের মাধ্যমে এ চাঁদাবাজির টাকা ভাগবাটোয়ারা করা হয়। ডাকবাংলো মোড়ে খুলনা জেলা বেবি ট্যাক্সি শ্রমিক ইউনিয়নের কার্যালয় অবস্থিত। সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন সোনা জাতীয় শ্রমিক লীগ মহানগর কমিটির সহসভাপতি। তার সংগঠনের আওতায় গাড়ি চলে ১৮০ থেকে ২০০টি। তবে চালকরা জানান, এই ইউনিয়নে চালক সংখ্যা প্রায় ৪০০।
চালকদের সবচেয়ে বড় সংগঠন দৌলতপুর-খুলনা বেবি টেক্সি সিএনজিচালিত অটোরিকশা থ্রি হুইলার ড্রাইভার্স ইউনিয়ন। সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক জহিরুল ইসলাম পান্নু খানজাহান আলি শ্রমিক লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি। এই সংগঠনের আওতায় চলে প্রায় ১ হাজার ২০০ গাড়ি। অপরটি খুলনা মহানগর ইজিবাইক শ্রমিক লীগ।
বিভিন্ন পয়েন্টে শ্রমিকদের কাছ থেকে চাঁদা আদায়ের জন্য যে জনবল নিয়োগ করা হয়েছে, তাদের বলা হয় স্ট্যাটার। দুই ইউনিয়নের হয়ে চাঁদা আদায়ে ৩০ থেকে ৩৫ জনের মতো স্ট্যাটার রয়েছেন।
সূত্র জানায়, ১ হাজার ৬০০ গাড়িতে দৈনিক গড়ে ৭৫ টাকা হিসাবে প্রতি মাসে আদায় ৩৬ লাখ টাকা। এ ছাড়া মাসের শুরুতে এককালীন ১০০ টাকা হিসেবে আদায় করা হয় ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা। এই টাকাও ভাগ করে নেন ইউনিয়নের নেতারা। তবে এই টাকা আদায় করা হয় গাড়ির মালিকের কাছ থেকে। মাসের শুরুতে এই টাকা ইউনিয়নে পৌঁছে দিতে হয় মালিককে নিজেকেই। এ ছাড়া নতুন কোনো গাড়ি নিবন্ধন করাতে হলে ইউনিয়নে ২ থেকে ৫ হাজার পর্যন্ত টাকা দিতে হয়।
খুলনা জেলা বেবি ট্যাক্সি শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন সোনা বলেন, শ্রম অধিদপ্তরের অনুমোদন নিয়ে প্রতিদিন গাড়ি থেকে ১০ টাকা আদায় করা হয়। তা দিয়ে অফিস ভাড়া, কর্মচারীদের বেতন, অন্য খরচ করা হয়। বাকি যে টাকা থাকে তা বিভিন্ন সময়ে শ্রমিকদের মৃত্যু ভাতা, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচ দেওয়া হয়। বিভিন্ন পয়েন্টে যে টাকা আদায় হয়, তা স্ট্যাটাররা ভাগ করে নেন। ওই টাকা ইউনিয়নে আসে না।
দৌলতপুর ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক জহিরুল ইসলাম পান্নু বলেন, একজন শ্রমিক মৃত্যুকালীন ভাতা পান ১০ হাজার টাকা। এর বাইরে অসুস্থ হলে, দুর্ঘটনা ঘটলে, বিভিন্ন সময় অনুদান দেওয়া হয়।
প্রতিদিন ৩০০ জনের বেশি চাঁদার টাকা দেয় না। প্রতিদিন আদায় হয় মাত্র ৩ হাজার টাকা। এই টাকা দিয়ে কী হয়? প্রতিদিন অফিস খুললে ৫ হাজার টাকা খরচ।
অন্তত ১০ জন চালকের সাথে কথা বলে জানা গেছে ইজিবাইকের আধিক্যের কারণে এই রুটে যাত্রী কমলেও জীবন যাত্রার খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে বহুগুন। এ ছাড়া ৫০০ টাকা গাড়ি ভাড়া ৫০০ টাকার তেল অথবা গ্যাস কেনার পর এই চাঁদার টাকা দিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে এসব চালকরা।
এদিকে খুলনা মহানগর ইজিবাইক শ্রমিক লীগের দুই নেতার ছত্রছায়ায় বিক্ষিপ্তভাবে স্ট্যাটারের মাধ্যমে ইজিবাইকচালকদের কাছ থেকে চাঁদা তোলা হয়। খুলনায় ইজিবাইকের সঠিক হিসাব না থাকলেও সিটি করপোরেশন এলাকায় ১০ হাজারের বেশি ইজিবাইক চলে বলে জানা যায়।
একাধিক চালক জানান ফুলতলা বাজার, শিরোমনি, মহাসীন মোড়, বয়রা বাজার, খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে, গল্লামারী ও ময়লাপোতায় ইজিবাইক থেকে চাঁদা তোলা হয়। ইজিবাইকের নির্দিষ্ট রুট মুজগুন্নী মহাসড়ক অর্থাৎ গল্লামারী ও নতুন রাস্তা মোডের দুই মাথায় সিরিয়াল দেওয়ার নাম করে স্ট্যাটারদের ১০ টাকা করে ২০ টাকা দিতে হয়। এ ছাড়া খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে রোগী নামালে বা ওঠালে এখান থেকে ১০ টাকা চাদা নেয় স্টাটার নামধারী চাঁদাবাজরা।
সূত্র আরও জানায়, প্রতিদিন অন্তত তিন হাজার ইজিবাইক থেকে ৩০ টাকা হারে চাঁদা তোলা হয়। এ ছাড়া ইজিবাইক নিবন্ধনের নামে টাকা আদায়ে নৈরাজ্য তো আছেই।
খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপকমিশনার (ট্রাফিক) মনিরা সুলতানা বলেন, তারা শ্রমিকদের কাছ থেকে কী বলে টাকা তোলে এটা শ্রমিক ও ইউনিয়নের বিষয়। পুলিশের কেউ এক টাকা কোথাও থেকে নেয় না। খুলনা বিআরটিএও এ বিষয়ে অভিন্ন বক্তব্য দিয়েছে।

#