খুলনায় বিচ্ছিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে ভোট গ্রহণ সম্পন্ন
# দুই প্রার্থীর ভোট বর্জন
# ককটেল উদ্ধার
# এজেন্ট ছিল না নৌকা ছাড়া কোন প্রার্থীর
# এক ভোটের বিনিময়ে এক প্যাকেট বিরিয়ানি প্রদান
মুহাম্মদ নূরুজ্জামান, খুলনা
দু’জন প্রার্থীর ভোট বর্জন, ভোট কেন্দ্রের সামনে থেকে ককটেল উদ্ধার, নৌকা প্রতীকের বাইরে অন্য প্রার্থীদের এজেন্ট না থাকা, নৌকা প্রতীকে প্রকাশ্যে সিল, নৌকার ভূয়া এজেন্ট আটক এবং একটি ভোটের বিনিময়ে এক প্যাকেট বিরিয়ানি প্রদানসহ বিচ্ছিন্ন বিভিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে রোববার খুলনার ছয়টি আসনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। ছয়টি আসনের মধ্যে তিনটিতে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী এবং স্বতন্ত্র পরিচয়ের প্রার্থীদের মধ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা অনুষ্ঠিত হয়। তবে খুলনা- ৪, ৫ ও ৬ আসনে প্রভাবশালী প্রার্থীদের মধ্যে সংঘাত-সংঘর্ষের আশঙ্কা থাকলেও তা হয়নি। ফলে সুষ্ঠুভাবপ ভোটগ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে।
এদিকে, খুলনা-৩ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী ফাতেমা জামান সাথী এবং খুলনা-১ আসনে তৃণমূল বিএনপি’র প্রার্থী গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিকের নানা অভিযোগে ভোট বর্জন করেছেন।
অপরদিকে বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকার অসংখ্য বুথ ঘুরে দেখা গেছে, নৌকা প্রতীকের এজেন্ট’র বাইরে দুই/একটি কেন্দ্রে স্বতন্ত্র প্রার্থীর এজেন্ট ছাড়া অন্য কোন প্রার্থীর এজেন্ট নেই। এছাড়া ডুমুরিয়ার একটি কেন্দ্রে নৌকার একজন ভুয়া এজেন্টকে আটক করা হয়। এ সময় একটি ভোট কেন্দ্রের সামনে থেকে একটি তাজা ককটেল উদ্ধার করে পুলিশ। বিকেল চারটায় ভোট গ্রহণ শেষে গণনা শুরু হয়।
নির্বাচনের শুরুতে খুলনার ছয়টি আসনের অধিকাংশ ভোটকেন্দ্রেই ফাঁকা ছিল। বেশ কয়েকটি কেন্দ্র ঘুরে দেখা যায়, ভোটারদের সামান্য উপস্থিতির মধ্যে বয়স্ক নারী পুরুষের সংখ্যায় বেশি ছিল। তবে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ওঠার উপস্থিতি বেড়ে যায়।
কেন্দ্রগুলো ঘুরে দেখা গেছে, অধিকাংশ কেন্দ্রের বুথগুলোতেই ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী নৌকার এজেন্ট ছাড়া তেমন কোন এজেন্ট ছিল না। সকাল আটটা চল্লিশ মিনিটে খুলনা-২ আসনের আওতাধীন মহানগরীর মোল্লাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় গিয়ে দেখা যায়, এই মহিলা কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি একেবারেই কম। কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার শুভঙ্কর সরকার জানান, এই কেন্দ্রে মোট ভোটার সংখ্যা ৩ হাজার ৬১ টি, সাতটি বুথ রয়েছে এখানে। এই কেন্দ্রে নৌকা এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী ঈগলের এজেন্ট ছাড়া কোন এজেন্ট পাওয়া যায়নি। একই আসনের হাজী আব্দুল মালেক মাধ্যমিক বিদ্যালয় পুরুষ কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, সকাল ৯ টায় ভোট পড়েছে ৭০ টি। কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার পরিমল বিশ্বাস জানান, ভোটার উপস্থিতি কম, যারা আসছেন বয়স্ক। এই কেন্দ্রের সাতটি বুথের মধ্যে ছয়টিতে নৌকার এজেন্ট ছাড়া অন্য কোন প্রার্থীর এজেন্ট ছিল না। তবে একটিতে স্বতন্ত্র প্রার্থীর এজেন্ট ছিল। একইভাবে হাজী আব্দুল মালেক ইসলামিয়া কলেজ শেখ হাসিনা মহিলা কেন্দ্র এবং হাজী আব্দুল মালেক ইসলামিয়া কলেজ অ্যাকাডেমিক ভবনে গিয়েও ভোটারদের কোন সিরিয়াল দেখা যায়নি। ভোটার উপস্থিতি খুবই কম ছিল। একাডেমিক ভবন কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার এ কে এম মাজহারুল আলম বলেন, সকাল সাড়ে ৯ টা পর্যন্ত এ কেন্দ্রে মোট ভোট পড়েছে ৯৩ টি। এ কেন্দ্রেও নৌকা প্রার্থীর এজেন্ট ছাড়া অন্য প্রার্থীর এজেন্ট কেমন ছিল না।
সরেজমিনে দেখা যায়, খুলনা-৪ আসনের দিঘলিয়া এমএ মজিদ ডিগ্রী কলেজ ও দিঘলিয়া (দঃ) সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভোটকেন্দ্রে শুরুতে ভোটার উপস্থিতি কম থাকলেও বেলা বাড়ার সাথে সাথে ভোটার উপস্থিতি ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। সকাল সাড়ে নয়টা পর্যন্ত সরকারি এম এ মজিদ ডিগ্রী কলেজ পুরুষ কেন্দ্রে ৩০০ জনের ভোট গ্রহণ সম্পন্ন হয়।
স্থানীয় লোকমান শেখ ভোট দেয়ার পর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, ভোট দিয়ে বের হলাম। শান্তিপূর্ণ ভাবে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ভোট দিতে আসার পথে কেউ বাধা সৃষ্টি করেনি।
অপরদিকে, খুলনা-৬ আসনের কয়রা উপজেলার বামিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের প্রতিটি কক্ষে বয়স্কদের এনে প্রকাশ্যে সিল মারতে দেখা যায়। মাঠে কোন ভোটারের লাইন ছিল না।
এদিকে, খুলনা-১ তৃণমূল বিএনপি’র প্রার্থী গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক ভোট বর্জন করেন। তার অভিযাগ, দাকোপ উপজেলার বেশির ভাগ ভোট কেন্দ্রে এজেন্টদের ভয়ভীতি প্রদর্শন করায় এবং আমাদের ভোটারদের ভয়ভীতি প্রদর্শন করায় ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত হয়নি। সকাল ৯ টা থেকে ৩ পর্যন্ত বিভিন্ন কেন্দ্রে সরজমিনে গিয়ে খুব কম সংখ্যক ভোটার পেয়েছি। তাতে সর্বোচ্চ ১০% ভোট পড়েছে মর্মে ধারণা। কিন্তু ১২ টার দিকে ভোটে কেন্দ্রে গিয়ে জানতে পারি ৬০% ভোট কাউন্ট হয়েছে। ফলে প্রহসনের ভোট আমরা প্রত্যাখ্যান করছি। একইভাবে খুলনা-৩ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী ফাতেমা জামান সাথীও নির্বাচন বর্জন করেছেন। তার অভিযোগ, আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকার প্রার্থী এস এম কামাল এবং তার সমর্থকরা তার কর্মীদের উপর হামলা চালিয়েছে এবং তাকে বাসভবনে অবরুদ্ধ করে রেখেছে। তিনি ফেসবুক ভাষণে প্রধানমন্ত্রীর কাছে এর বিচার দিয়েছেন।
অপরদিকে, খুলনা-৫ আসনের একটি ভোটকেন্দ্র থেকে একজন ভূয়া পোলিং এজেন্টকে আটক করা হয়। রোববার বেলা ১১টার দিকে ডুমুরিয়া উপজেলার শোভনা বিরাজময়ী মাধ্যমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্র থেকে তাকে আটক করা হয়। ওই কেন্দ্রে তিনি নৌকা প্রতীকের পোলিং এজেন্ট হিসেবে কাজ করছিলেন।
আটক জিল্লুর বাগাতি ডুমুরিয়া উপজেলার পূর্ব-শোভনা গ্রামের নওশের বাগাতির ছেলে।
ওই এলাকায় দায়িত্বে থাকা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ইসমাইল হোসেন বলেন, কেন্দ্রটিতে গিয়ে এজেন্টের দেখতে চাইলে তিনি নিজেকে এজেন্ট বলে পরিচয় দেন। তবে কোনো নিয়োগপত্র দেখাতে পারেননি। তাই তাকে আটক করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
কেন্দ্র থেকে সাংবাদিক এবং এজেন্ট বের করে দেয়ার অভিযোগ :
ডুমুরিয়া উপজেলার কূলটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র থেকে সাংবাদিক এবং ঈগল প্রতীকের এজেন্টকে বের করে দেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিকেল চারটায় ভোটগ্রহণ শেষে গণনার সময় উপস্থিত থাকতে চাইলে সেখানকার দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রিজাইডিং অফ সনাতন সরকার স্বতন্ত্র প্রার্থীর এজেন্ট এবং সাংবাদিকদের একটি টিমকে বের হয়ে যেতে বলেন। এ সময় তারা গণনার সময় থাকার আইনি ভিত্তি রয়েছে- উল্লেখ করলে নৌকা প্রতীকের সমর্থক দুই-তিন শতাধিক যুবক সেখানে এসে বিশৃঙ্খলা শুরু করে। এক পর্যায়ে সাংবাদিকরা সেখান থেকে বের হয়ে যেতে বাধ্য হন। ওই কেন্দ্রে জাল ভোট প্রদানের অভিযোগ করেছেন ঈগল প্রতীকের প্রার্থী আকরাম হোসেন। একই সঙ্গে তিনি সেখানে নৌকা প্রতীকের সমর্থকরা ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করে বলেও অভিযোগ করেন। এ বিষয়ে ডুমুরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নুরুল আলম বলেন, প্রিজাইডিং অফিসারকে তার রেফারেন্স দিয়ে জানাতে বলেন গণনার সময় সেখানে এজেন্ট এবং সাংবাদিকদের থাকার আইন রয়েছে।
একটি ভোটের বিনিময়ে এক প্যাকেট বিরিয়ানি :
খুলনা-২ আসনের আওতাধীন পশ্চিম টুটপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ১টি ভোটের বিনিময়ে ১ প্যাকেট বিরিয়ানি দেওয়া হয়। ভোটাররা ভোট দিয়ে বের হওয়ার পরে আগে থেকে দেয়া স্লিপ দেখিয়ে বিরানির প্যাকেট গ্রহণ করেন। এ সময় ভোটকেন্দ্রে ভোটারদের লাইন না থাকলেও বিরানির প্যাকেট নেয়ার জন্য লম্বা লাইন দেখা যায়।
উল্লেখ্য, খুলনার ৬ আসনে বিএনপি-জামায়াতসহ সমমনাদের বয়কটের মধ্য দিয়ে এ ভোটে দুজন নারীসহ ৩৯জন প্রার্থী অংশগ্রহণ করেন। ছয়টি আসনের মধ্যে দুটি মহানগরীর ও বাকি চারটি জেলা সীমানায়।
রিটার্নিং কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসক খন্দকার ইয়াসির আরেফিন জানান, এবারের নির্বাচনে খুলনার ৬টি আসনে মোট ভোটার রয়েছে ১৯ লাখ ৯৯ হাজার ৮৮১ জন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটার ছিল ১৮ লাখ ১ হাজার ২ জন। ৬টি আসনে ৭৯৩টি ভোট কেন্দ্র ও ৪ হাজার ৭২০টি ভোট কক্ষ থাকবে। ৬টি আসনে এবার গুরুত্বপূর্ণ (ঝুঁকিপূর্ণ) কেন্দ্রের সংখ্যা ৬৩১টি।
রিটার্নিং কর্মকর্তা বলেন, নির্বাচনে খুলনা জেলার ৬টি আসনে ৫ হাজার ২২৫ জন পুলিশ, ৯ হাজার ৫১৬ জন আনসার, ৯৬ জন র্যাব সদস্য, ১৯ প্লাটুন বিজিবি, ৫৯৬ জন কোস্টগার্ড সদস্য, ৬৪৬ জন দফাদার আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় দায়িত্ব পালন করছে। এছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় তাদের পাশাপাশি নৌ পুলিশের সদস্যরাও রয়েছে। তাছাড়া মহানগরী ও উপজেলা পর্যায়ে সেনাবাহিনীর ৬০০ সদস্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় দায়িত্ব পালন করছে।
তিনি বলেন, নির্বাচনে ৪৬ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও ১৫ জন জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট দায়িত্ব পালন করছেন। জেলায় মোট ভোটকেন্দ্র রয়েছে ৭৯৩টি