দেড় বছরে খুলনায় অন্তত অর্ধশত হত্যাকাণ্ড
ফাহিম ইসলাম,বিশেষ প্রতিনিধিঃ
খুনের নগরী খুলনা গত দেড় বছরে হত্যা ও সহিংস অপরাধ ভয়াবহ মাত্রা ধারণ করেছে। ২০২৪ সালের অক্টোবর মাস থেকে ২০২৫ সালের ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়কালে খুলনা মহানগর ও জেলার বিভিন্ন এলাকায় সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, এ সময়ে অন্তত ৪৫ থেকে ৫০টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। তবে একাধিক দায়িত্বশীল সূত্রের দাবি, প্রকৃত সংখ্যা ৭২টিরও বেশি হতে পারে।
এসব হত্যাকাণ্ডের মধ্যে গুলি করে হত্যা, ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা এবং প্রকাশ্য স্থানে নৃশংসভাবে হত্যার ঘটনাই বেশি দেখা গেছে।
খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ (কেএমপি) ও জেলা পুলিশের একাধিক সূত্র জানায়, অধিকাংশ হত্যাকাণ্ডের পেছনে আধিপত্য বিস্তার, রাজনৈতিক বিরোধ, চাঁদাবাজি, পূর্বশত্রুতা, মাদক ব্যবসা এবং অপরাধী গোষ্ঠীর অভ্যন্তরীণ কোন্দল জড়িত। কিছু ঘটনায় ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব ও জমি সংক্রান্ত বিরোধও হত্যার কারণ হিসেবে উঠে এসেছে।
আদালত চত্বরে জোড়া খুন, দেশজুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া
এই সময়ের সবচেয়ে আলোচিত ও ভয়াবহ ঘটনা ঘটে ২০২৫ সালের ৩০ নভেম্বর। খুলনা আদালত চত্বরে—যেখানে বিচারপ্রার্থীরা ন্যায়বিচারের আশায় উপস্থিত থাকেন—সেখানেই প্রকাশ্যে গুলি ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে দুইজনকে হত্যা করা হয়। আদালত প্রাঙ্গণে সংঘটিত এই জোড়া খুনের ঘটনায় সারাদেশে তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি হয় এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে ব্যাপক প্রশ্নের জন্ম দেয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, আদালত এলাকায় অবস্থানরত অবস্থাতেই দুর্বৃত্তরা নির্বিঘ্নে হামলা চালায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতির মধ্যেও এমন ঘটনা ঘটায় সাধারণ মানুষের মধ্যে চরম আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এই ঘটনায় আদালত চত্বরের নিরাপত্তা ব্যবস্থার গুরুতর ঘাটতি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়।
প্রকাশ্য স্থানে বাড়ছে সহিংসতা
আদালত চত্বরের বাইরেও খুলনার ব্যস্ত সড়ক, আবাসিক এলাকা ও ব্যবসায়িক অঞ্চলে একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। কোনো কোনো ঘটনায় প্রকাশ্য দিবালোকে গুলি চালানো হয়েছে, আবার কোথাও রাতের আঁধারে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এসব ঘটনায় নগরবাসীর মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে।
সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, কোনো কোনো মাসে একাধিক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। বিশেষ করে ২০২৫ সালে কয়েক দফায় পরিকল্পিত খুন ও গুলিতে হত্যার ঘটনা ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। অনেক ঘটনায় মামলা হলেও বেশ কয়েকটি মামলার তদন্ত এখনো শেষ হয়নি এবং কিছু ঘটনায় মূল অভিযুক্তরা পলাতক রয়েছে।
পুলিশের বক্তব্য ও বিশ্লেষকদের মত
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, অপরাধ দমনে নিয়মিত টহল, বিশেষ অভিযান, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে অভিযান এবং তালিকাভুক্ত অপরাধীদের ওপর নজরদারি জোরদার করা হয়েছে। পুলিশের দাবি, বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডের রহস্য ইতোমধ্যে উদ্ঘাটন করা হয়েছে।
তবে অপরাধ বিশ্লেষকদের মতে, শুধু অভিযান দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা, মাদক ও অবৈধ অস্ত্রের সহজলভ্যতা এবং বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা অপরাধ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। দ্রুত ও দৃষ্টান্তমূলক বিচার নিশ্চিত না হলে পরিস্থিতি আরও অবনতির আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে করছেন তারা।
সচেতন নাগরিক ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মতে, খুলনার মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগীয় শহরে ধারাবাহিকভাবে হত্যাকাণ্ড বেড়ে যাওয়া অত্যন্ত উদ্বেগজনক। বিশেষ করে আদালত চত্বরে জোড়া খুনের মতো ঘটনা প্রমাণ করে—অপরাধীরা কতটা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তারা নাগরিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জরুরি ও কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন।
