মাদক–চোরাচালান, গ্যাং আধিপত্য ও প্রতিনিয়ত হত্যাকাণ্ডে আতঙ্কে খুলনা নগরবাসী

IMG-20251127-WA0019

বিশেষ প্রতিনিধি, খুলনা

খুলনা নগরী ও উপকণ্ঠে সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে গুলি, কুপিয়ে হত্যা ও টার্গেট কিলিং ঘটনাগুলো ভয়াবহভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। কেএমপি এবং র‌্যাবের নিয়মিত অভিযান চললেও লবণচরা, রূপসা এবং সদর থানাসহ বিভিন্ন এলাকায় ধারাবাহিক হত্যাকাণ্ড জনজীবনে নেমে এসেছে চরম আতঙ্ক।

শেল্টার থেকে বেরিয়ে সক্রিয় সন্ত্রাসী বাহিনী

স্থানীয় সূত্র জানায়, খুলনার আলোচিত শেখ বাড়ির শেল্টারে ৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত শহরের সক্রিয় ৬টি সন্ত্রাসী বাহিনীর প্রধানরা অবস্থান করছিল। সে সময় তাদের মধ্যে সমঝোতা থাকায় খুন-খারাবি কম ছিল। তবে পরবর্তী সময় মাদক কারবারের নিয়ন্ত্রণ এবং আধিপত্য বিস্তার নিয়ে তাদের মাঝে সংঘর্ষ বাড়তে থাকে। শহরের বিভিন্ন এলাকা রাতের পর রাত রণক্ষেত্রে পরিণত হয়।

কেএমপি: “মাদকের আধিপত্য নিয়েই প্রতিরাতে খুনখারাবি হচ্ছে”

কেএমপি’র সহকারী পুলিশ কমিশনার (মিডিয়া অ্যান্ড সিপি) ম রোকনুজ্জামান বলেন—
“চোরাচালানের মাধ্যমে আসা মাদকের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে প্রতিরাতে খুন-খারাবির ঘটনা ঘটছে। সরকার পতনের পরপর পুলিশের নিষ্ক্রিয়তায় ৬টি সন্ত্রাসী বাহিনী হঠাৎই সক্রিয় হয়ে ওঠে। এরা জনমনে চরম আতঙ্ক সৃষ্টি করছে। আমরা নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছি।”

র‌্যাব-৬: হত্যাকাণ্ড বেড়েছে, অভিযান চলছে

র‌্যাব-৬ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল নিস্টার আহমেদ স্বীকার করেন, খুলনায় হত্যাকাণ্ড বাড়ছে। তিনি জানান—
“মাদকের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান চলছে। গ্রেপ্তার হওয়া আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে চালান দেওয়া হচ্ছে। সাম্প্রতিক হত্যাগুলোর আসামিদের ধরতে র‌্যাব-পুলিশ যৌথভাবে অভিযান চালাচ্ছে।”

তিনি আরও বলেন, “খুন-খারাবি একটি সামাজিক ব্যাধি। প্রশাসনের একার পক্ষে এটিকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। সমাজের সব শ্রেণীকে এগিয়ে আসতে হবে।”

থানাভিত্তিক সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ড

নীচে খুলনার তিনটি গুরুত্বপূর্ণ থানায় সাম্প্রতিক যেসব খুন ও কুপিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটেছে তার সারসংক্ষেপ তুলে ধরা হলো

১) লবণচরা থানা

লবণচরা এলাকায় একাধিক কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যার ঘটনা ঘটেছে।

কয়েকদিন আগে রাতের অন্ধকারে সশস্ত্র দুর্বৃত্তরা এক যুবককে কুপিয়ে হত্যা করে রাস্তার পাশে ফেলে রেখে যায়।

একই এলাকায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষে দু’পক্ষের গোলাগুলির ঘটনাও নথিভুক্ত হয়েছে।

স্থানীয়দের অভিযোগ—মাদক ও টোকেনবাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের জেরে এলাকায় প্রতিনিয়ত উত্তেজনা বিরাজ করছে।

২) রূপসা থানা

রূপসায় যদুবয়রা ইউনিয়নের চৌরঙ্গী বাজার এলাকায় সোহেল (৫০) নামে এক ব্যক্তিকে পথ আটকে গুলি করে হত্যা করা হয়। তার দেহে একাধিক গুলির চিহ্ন ছিল।

নৈহাটি ইউনিয়নের জয়পুর মাস্টারবাড়ি এলাকায় আরেক যুবককে বাড়ির সামনে গুলি করে হত্যা করা হয়। ঘটনাস্থল থেকে গুলির খোসা উদ্ধার করে পুলিশ।

মাদক কারবারের টাকার ভাগাভাগি নিয়ে সংঘর্ষের জেরে জবাই ও কুপিয়ে হত্যার ঘটনাও ঘটেছে রূপসায়।

এ থানায় টার্গেট কিলিং ও রাতের সন্ত্রাস—দু’টিই বেড়েছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছে।

৩) খুলনা সদর থানা

সদর থানার বিভিন্ন এলাকায় কুপিয়ে, গুলি করে ও দলবদ্ধ হামলায় হত্যার ঘটনা বেড়েছে।

কয়েকদিন আগে শহরের সঙ্গীতা সিনেমা হলের নিচে এক ব্যক্তি—প্রথমে গুলি, পরে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।

মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ, টোল আদায়ের বিরোধ ও পূর্ব শত্রুতাকে কেন্দ্র করে এসব হত্যাকাণ্ড বেশি ঘটে।

পুলিশের দাবি—অধিকাংশ ঘটনায় জড়িতরা সংঘবদ্ধ সন্ত্রাসী বাহিনীর সদস্য।

কেন বাড়ছে হত্যাকাণ্ড?

মাদক কারবার নিয়ন্ত্রণ

গ্যাং ও টোকেন ব্যবসার আধিপত্য বিস্তার

চোরাচালান রুটের নিয়ন্ত্রণ

পূর্ব শত্রুতা ও টার্গেট কিলিং

রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর আইনশৃঙ্খলা দুর্বলতা

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে—
সাম্প্রতিক সময় খুলনায় ভাড়াটে খুনি ব্যবহার, হিটম্যান নিয়োগ ও গ্যাং-ওয়ার বাড়ায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে।

জনজীবনে ভয় ও আতঙ্ক

হত্যাকাণ্ড বাড়ায় রাতের শহর এখন প্রায় ফাঁকা।
দোকানপাট আগেভাগে বন্ধ হচ্ছে।
জনগণ বলছে,
“এখন রাত নয়, সন্ধ্যার পরও বাইরে যাওয়া ভয় লাগে।”