কালীগঞ্জে মাদকের ভয়াবহ বিস্তারযুবসমাজ ধ্বংসের মুখে, উদ্বেগ বাড়ছে এলাকাবাসীর

IMG-20251125-WA0013

মোঃ আবু সাইদ শওকত আলী ,
       খুলনা বিভাগীয় প্রধানঃ

ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলায় দিন দিন মাদকের বিস্তার ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে। শহর থেকে গ্রামসহ সব খানেই ছড়িয়ে পড়েছে মাদকসেবী ও ব্যবসায়ীদের নেটওয়ার্ক। বিশেষ করে ইয়াবা, ফেনসিডিল ও গাঁজার সহজলভ্যতা কিশোর যুবকদের নেশার দিকে ঠেলে দিচ্ছে দ্রুতগতিতে। এর পাশাপাশি দেশে নতুন করে ঢুকছে ট্যাফেন্ডাডল নামের আরেকটি নেশা জাতীয় ট্যাবলেট।
স্থানীয়দের  দাবি উঠতি বয়সের তরুণরা নেশার টাকার জন্য চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি, রাহাজানির মতো অপরাধে জড়াচ্ছে, ফলে পুরো এলাকায় চরম নিরাপত্তাহীনতা বিরাজ করছে। শহর সহ বিভিন্ন গ্রামে অবাধে চলছে মাদকের ব্যবসা।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, কালীগঞ্জ পৌর এলাকা ছাড়াও আশপাশের বহু গ্রামে মাদক ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য তীব্রভাবে বেড়ে গেছে। এর মধ্যে কাশিপুর, চাচড়া, শিবনগর, আড়পাড়া, নদী-আড়পাড়া, ঢাকালে পাড়া, বলিদাপাড়া, সিংঙ্গী, রায়গ্রাম, দুলালবন্দিয়া, ফয়লা, হেলাই, মাস্টারপাড়া, পাইকপাড়া, চাপালী, শ্রীরামপুর, আনন্দবাগ, খয়েরতলা, বাকুলিয়া, ভাটপাড়া, মহাদেবপুর ও আলাইপুর সহ আশপাশের গ্রামগুলোতে সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত দেদারসে মাদক বিক্রি চলার অভিযোগ পাওয়া গেছে।

এলাকাবাসী জানায়, মাদক ব্যবসায়ীরা শুধু বিক্রিই করছে না, বরং বাইরের জেলা থেকে আসা মাদকসেবীদেরও নেশা করার নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করে দিচ্ছে। অনেক যুবক পাশের জেলা থেকে এখানে এসে নেশা করে যাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান চালালেও মাদকচক্রের দৌরাত্ম্য কমছে না

র‌্যাব, জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি), থানা পুলিশ এবং মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরসহ তিন সংস্থা মিলেই নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছে। মাঝেমধ্যে মাদকসহ একাধিক মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তারও করা হয়। তবে অভিযোগ, অল্পদিনের মধ্যেই জামিনে বেরিয়ে এসে তারা আবার আগের মতোই মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছে।

স্থানীয় ও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের ভাষ্য, যতই অভিযান হোক, সমস্যার স্থায়ী সমাধান হচ্ছে না। মাদক যেন আরও ছড়িয়ে পড়ছে শহর থেকে গ্রাম অঞ্চলে। এসব নেশাতে জড়িয়ে পড়ছে নামিদামি পরিবারের সন্তানেরাও। মাদকাসক্তদের মধ্যে এখন সম্ভ্রান্ত ও শিক্ষিত পরিবারের তরুণদের সংখ্যাও দ্রুত বাড়ছে। এতে পরিবারে অস্থিরতা, সামাজিক অবক্ষয় এবং অপরাধপ্রবণতা ভয়াবহভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তারা বলেন, মাদকের কারণে পুরো সমাজটাই ভেঙে পড়ছে। আজ আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে।

স্থানীয় সাংবাদিক ও ব্যবসায়ী আনোয়রুল ইসলাম রবি বলেন, আগের দিনের সেই শান্ত গ্রামগুলো এখন নেশার দখল পড়ে হারিয়ে যাচ্ছে যুবসমাজের ভবিষ্যৎ। এক সময় যেসব গ্রাম সন্ধ্যা নামলে নিস্তব্ধতায় ভরে উঠত, আজ সেখানে রাত গভীর হলে শুরু হয় আরেক জগৎ। ভোর থেকে গভীর রাত জুড়ে পুরো সময়টাই যেন নেশার এক অদৃশ্য ¯্রােতে ডুবে থাকে শহর ও আশপাশের এলাকা। রাস্তার মোড়, বাগানের আড়াল, পরিত্যক্ত ঘর-বাড়ি সব জায়গাই যেন নেশা সেবীদের স্পট। মাদক এখন শুধু একটি অবৈধ দ্রব্য নয়, এটি এলাকাবাসীর জীবনের সবচেয়ে বড় আতঙ্ক। এখন যুবকদের চোখে স্বপ্ন নেই, আছে শুধু নেশা। তিনি আরও বলেন, নামিদামি পরিবারও রেহাই পাচ্ছে না, মাদক শুধু দরিদ্র ঘরের সন্তানদের নয়, বরং প্রতিষ্ঠিত ও সচ্ছল পরিবারের তরুণদেরও টেনে নিচ্ছে। অনেক ভালো ছাত্রকে কয়েক মাসের ব্যবধানে পুরোপুরি বদলে যেতে দেখেছি। নেশা মানুষকে ভেতর থেকে ভেঙে দেয়। নেশা দ্রুত তরুণদের মধ্যে ডিপ্রেশন, মানসিক অস্থিরতা, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্নতা তৈরি করছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন প্রতিনিধি জানান, একসময় তরুণদের চোখে ছিল স্বপ্ন, সে জায়গা দখল করে নিয়েছে ইয়াবার লাল ট্যাবলেট আর ফেনসিডিলের লালচে বোতল। ১২/১৩ বছরের কিশোররা পর্যন্ত এখন নেশার জগতে ঢুকে পড়ছে। আমাদের সন্তানেরা এখন নেশার টাকা জোগাতে চুরি, ছিনতাই, রাহাজানির মতো ছোট বড় অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। ফলে একদিকে পরিবারে অস্থিরতা, অন্যদিকে সমাজে অনিরাপত্তা তৈরি হয়েছে। গ্রামগুলোতেও নেশার বাজারের চাহিদা বেশি, ভয় কম। এখানে মাদক পাওয়া যায় হরহামেশাই। বিক্রেতারা ভয় পায় না। এলাকাবাসী বললেই বিপদে পড়ে। যারা একটু সচেতন তারা সন্ধ্যা হলেই ছেলেকে বাসায় আটকে রাখে। ভয় পায় বাইরে গেলে কোন বন্ধু তাকে কোথায় টেনে নিয়ে যাবে।

আশপাশের গ্রামগুলোতে মানুষ প্রায় একই কথা বলেন, মাদক বিক্রি হচ্ছে খোলামেলা, কেউ এ সম্পর্কিত বিষয়ে কথা বলতে ভয় পায়। বাইরের জেলা থেকেও তরুণরা এখানে এসে নেশা করছে। ব্যবসায়ীরা নাকি তাদের জন্য নেশা করার জন্য নিরাপদ স্পটও তৈরী করে দেয়। অভিযান আছে, কিন্তু স্থায়ী সমাধান নেই। প্রশাসন নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছেন। মাঝেমধ্যে গ্রেপ্তারও হয়, কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই জামিনে বেরিয়ে আবার পুরনো ব্যবসায় ফিরে আসে বেশিরভাগই। এলাকাবাসীর অভিযোগ অভিযান হয়, কিন্তু বদলায় কিছুই না। আমরা শুধু দেখি ধরা পড়ে, আদালত থেকে জামিন নিয়ে আবার আগের মতো চলে। এতে মাদক ব্যবসায়ীরা আরও সাহসী হয়।

কালীগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) শফিকুল ইসলাম মাদকবিরোধী অভিযানের বিষয়ে সাধারণ নীতিগত অবস্থান তুলে ধরে বলেন, কালীগঞ্জকে মাদকমুক্ত করতে আমরা প্রতিনিয়ত অভিযান পরিচালনা করছি। মাদক ব্যবসায়ী বা সেবনকারী কেউই ছাড় পাবে না। আইন অনুযায়ী কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। আমরা চাই স্থানীয় জনগণও তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করুক, তাহলেই মাদকচক্রকে সম্পূর্ণরূপে দমন করা সম্ভব। মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে দীর্ঘমেয়াদী ও সমন্বিত অভিযান চলমান রাখছি। থানা পুলিশ নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছে এবং আরও কঠোর হবে। তিনি বলেন, মাদক প্রতিরোধে পুলিশের পাশাপাশি সমাজের সচেতন মহলেও সচেতন হতে হবে। পরিবার, বিদ্যালয়, স্থানীয় নেতৃত্ব সবাই অংশ নিলে মাদকচক্রকে ভেঙে ফেলা সম্ভব হবে।

কালীগঞ্জের মাটি একসময় পরিচিত ছিল সংস্কৃতি, শান্তি আর সৌহার্দ্যের জন্য। আজ সেই মাটিতেই ছড়িয়ে পড়ছে নেশার কালো ছায়া। যুবসমাজের ভবিষ্যৎ, পরিবারের শান্তি, সমাজের নিরাপত্তাসহ সবকিছুই এখন এক ভয়াবহ হুমকির মুখে। মাদকের বিরুদ্ধে সমাজ, প্রশাসন, পরিবারের সমন্বিত প্রতিরোধর এখনই সময়। নাহলে অন্ধকারের হাত থেকে আর হয়তো ফিরে আসা যাবে না।

এলকাবাসীর দাবী-

এলাকাভিত্তিক চেকপোস্ট ও টহল জোরদার।

স্কুল কলেজে মাদকবিরোধী সচেতনতা কর্মসূচি।

মাদকাসক্তদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসন ব্যবস্থা।

স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও পুলিশের সমন্বিত পরিকল্পনা।

মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা।