আনোয়ার নামেই টিকে আছে পারকি সমুদ্র সৈকত।

আহমদ রেজা আনোয়ারা, চট্টগ্রাম বিভাগীয় ব্যুরো প্রধানঃ
২৯সেপ্টেম্বর ২০২৫,
একসময় নাম ছিল (ফুলতলী) ২০০৮ সালে পর্যটক আনাগোনা নাম হয়েছে ‘ঝাউবাগান’। ঝাউগাছের ঘন ছায়ায় বসে দেখা যেত জাহাজ চলাচল, লাল কাঁকড়ার দৌড়ঝাঁপ আর সূর্যাস্তের মনোরম দৃশ্য। এ সৌন্দর্যের কারণেই চট্টগ্রামের আনোয়ারার পারকি সৈকতের খ্যাতি ছড়িয়েছিল দেশজুড়ে। বিশেষ করে চট্টগ্রাম শহর থেকে কম সময়ে, কম খরচে ঘুরতে যাওয়ার সুযোগ থাকায় দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল জায়গাটি।
সেই পারকির চর আর আগের মতো নেই। পর্যটকের ভিড় থাকলেও সৌন্দর্যের অনেকটাই মুছে গেছে। ঝাউগাছও কমেছে, জোয়ারের পানিতে বিলুপ্ত হয়ে পড়ছে ঝাউ গাছ ও গাছের সৌন্দর্য, বসার জায়গাও তেমন নেই, সন্ধ্যা নামতেই আশপাশে নামে গুটগুটে অন্ধকার। আবার লাল কাঁকড়াও আগের মতো দেখা যাচ্ছে না। ন্যূনতম অবকাঠামোগত সুবিধা না থাকায় দর্শনার্থীরাও ফিরে যাচ্ছেন হতাশ হয়ে। দুই বছর ধরেই এসব অব্যবস্থাপনার মধ্যে রয়েছে সৈকতটি।
সৈকতের অবস্থা দেখতে গত শুক্রবার বিকেলে সরেজমিনে যান প্রতিবেদক। প্রধান সড়ক থেকে সৈকতে প্রবেশ করতেই দেখা যায় সময় বিভিন্ন যানবাহন থেকে টোল নেওয়া হচ্ছে। জিজ্ঞেস করলে চৌকিদার জানান,উপজেলা কতৃক লিস্টে নেওয়া, এসব নিয়েও পর্যটকদের সঙ্গে টোল আদায়কারীদের বাগ্বিতণ্ডা হচ্ছে হরদমই । অনেকেই টোল দেওয়ার ঝামেলা এড়াতে সৈকত না গিয়ে ফিরে যাচ্ছেন আবার বলেন তারা পার্কিং ব্যবস্থা সুবিধা জনক নাই। টোল বক্স অতিক্রম করতেই চোখে পড়ে রাস্তার দুই পাশ দখল করে গড়ে তোলা দোকান ও ঝুপড়ি একটা সময় ঝাউগাছ ঘিরে ছিল। আজ আর নেই।একটু এগিয়ে সৈকতে নামতেই দেখা গেল জোয়ারের পানি একেবারে রাস্তা ছুঁই ছুঁই করছে। সামনেই পড়ে রয়েছে চারটি ঝাউগাছ।তাও আবার জোয়ারের পানিতে ঘোরালি থেখে বালি সরে গিয়ে গাছের ঘোরালি উপড়ে।যার ফলে পারকি সমুদ্র সৈকতে সৌন্দর্য কমতে শুরু করেছে।
সৈকতটিতে গত ৪ বছরে পাঁচ শতাধিক বেশি ঝাউগাছ উপড়ে পড়েছে। একটু সামনে আগাতেই দেখা যায় বিস্তীর্ণ সৈকতে নামতে শুরু করেছেন লোকজন। তবে আশপাশের বসার জায়গা না পাওয়ায়,ভালো মানের খাবার পরিবেশ,বৈদ্যুতিক সংযোগ না থাকায়, হতাশ হচ্ছেন অনেকে।
স্থানীয় লোকজন ও বেড়াতে আসা পর্যটকরা জানালেন, শুধু এই দুই গাছ নয়, সৈকতটিতে গত চার বছরে তিন শতাধিকের বেশি ঝাউগাছ উপড়ে পড়েছে। বিকাল বেলায় মিষ্টি রোদে দর্শনার্থী দেখা যায়,বিস্তীর্ণ সৈকতে নামতে শুরু করেছেন লোকজন। তবে আশপাশের বসার জায়গা না পাওয়ায় হতাশ হচ্ছেন অনেকে।
সরেজমিনে দেখা যায়, পারকি সৈকতটি মূল পয়েন্ট থেকে আধা কিলোমিটার দক্ষিণ ও দুই কিলোমিটার উত্তরে কর্ণফুলী নদীর মোহনার কাছাকাছি পর্যন্ত বিস্তৃত। তবে পর্যটকেরা মূল পয়েন্টের এক থেকে দেড় কিলোমিটার জায়গাজুড়ে বিচরণ করেন। দেড় কিলোমিটার জায়গায় কোনো রেস্তোরাঁ কিংবা রিসোর্ট নেই। ফলে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে সৈকতসংলগ্ন ঝুপড়ির দোকান থেকে খাবার খেতে হয় দর্শনার্থীদের।
স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ছুটির দিনে অন্তত পাঁচ হাজার দর্শনার্থী পারকি সৈকত ঘুরতে আসেন। কিন্তু এসবের বিপরীতে পর্যাপ্ত অবকাঠামো নেই। নামমাত্র দুটি রেস্তোরাঁ, ২০টির ঝুপড়ি দোকান, ৩০টি অস্থায়ী দোকান রয়েছে। এর বাইরে চারটি স্পিড বোট, আটটি বিচের চার চাকা মোটরসাইকেল রয়েছে। দুটি পাবলিক শৌচাগার থাকলেও সুপেয় পানির ব্যবস্থা সেখানে নেই। আবার সৈকত এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকায় সন্ধ্যা নামতেই ভুতুঁড়ে পরিবেশ তৈরি হয়।
কুষ্টিয়া মেহের জেলা থেকে বেড়াতে আসা গাদ্দাফি রাজন গনমাধ্যমকে বলে, ‘অনেক নাম শুনেছি পারকি সমুদ্র সৈকতের, এশিয়া মহাদেশে বৃহৎ কর্ণফুলী টানেল সংযুক্ত বিষয় টি আমার ও পরিবার দেখার ইচ্ছা ছিল, বেড়াতে আমরা এ সৈকতে এসেছি। তবে অব্যবস্থাপনার কারণে নানান হয়রানির শিকার হতে হয়েছে।’ ঢাকা মিরপুর থেকে বেড়াতে আসা তানবির বলেন, ‘সৈকতের নাম শুনে এখানে বেড়াতে এসেছি। কিন্তু এখানে বসার জায়গাও নেই। এ নিয়ে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।’
বন বিভাগ সূত্র জানায়, আনোয়ারা উপকূলকে রক্ষা জন্য পারকি সৈকতের বালিয়াড়িতে ১৯৯২-৯৩ অর্থবছরে ১২ হেক্টর জায়গায় আর্কিটেকচারাল পদ্ধতিতে ঝাউগাছ লাগানো হয়। এরপর ১৯৯৩-৯৪ অর্থবছরে ১৭ দশমিক ২ হেক্টর, ২০০৩-০৪ অর্থবছরে ৫ হেক্টর ও ২০০৪-০৫ অর্থবছরে ৫ হেক্টর জায়গায় ঝাউবাগান করা হয়। এই সবুজ বেষ্টনী পারকি সৈকতের সৌন্দর্য বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি থেকেও রক্ষা করত। তবে প্রতিবছরই দুর্যোগেই সৈকতের ঝাউগাছ কমেছে।
ছুটির দিন এলেই সৈকতটিতে বাড়ে পর্যটকের ভিড়। তবে পর্যাপ্ত অবকাঠামো ও ব্যবস্থাপনা না থাকায় হতাশ হয়ে ফিরে যায় তাঁরা,
সেই পারকি আর আগের মতো নেই। পর্যটকের ভিড় থাকলেও সৌন্দর্যের অনেকটাই মুছে গেছে। ঝাউগাছও কমেছে, বসার জায়গাও তেমন নেই, সন্ধ্যা নামতেই আশপাশে নামে গুটগুটে অন্ধকার। আবার লাল কাঁকড়াও আগের মতো দেখা যাচ্ছে না। ন্যূনতম অবকাঠামোগত সুবিধা না থাকায় দর্শনার্থীরাও ফিরে যাচ্ছেন হতাশ হয়ে তাঁরা।
অন্যদিকে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন সূত্র জানায়, ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে পারকি সৈকতসংলগ্ন এলাকায় ১৩ দশমিক ৩৩ একর জায়গায় ৭৯ কোটি টাকার একটি উন্নয়ন প্রকল্প শুরু হয়। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে পুরো প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। তবে এখনো এ প্রকল্পের কাজ শেষ হয়নি। প্রকল্পটির কাজ পুরোপুরি শেষ হলে পারকি সৈকতের চিরচেনা চেহারা বদলে যেত।
পারকি সৈকতের দোকানি লেয়াকত আলী বলেন, পারকি সৈকতের মূল আকর্ষণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। এটিই এখন আর নেই। লাল কাঁকড়া এখন তেমন দেখতে পাওয়া যায় না। আগে সারা বছর এটি দেখা যেত। তাই পর্যটকেরা হতাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছেন।
সৈকতের পাশের একটি হোটেলের কর্মচারী মো. রানা বলেন, সৈকতের উত্তর পাশে বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকায় সন্ধ্যার পরপরই পর্যটকেরা আর সৈকতে থাকছেন না।
জানতে চাইলে পারকি সৈকত পর্যটন কমপ্লেক্সর প্রকল্প পরিচালক মাজেদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, পুরো প্রকল্পের কাজ ৮০ শতাংশের বেশি শেষ। আগামী ডিসেম্বরের আগে পুরো প্রকল্পটি বুঝে পাব। তখন সেবার মান বৃদ্ধি পাওয়া। পর্যটকেরাও সন্তুষ্ট হবেন।