বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক আবারও প্রাণীর মৃত্যু নিয়ে লুকোচুরি
গাজীপুরের শ্রীপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে আবারও প্রাণীর মৃত্যু নিয়ে লুকোচুরির ঘটনা ঘটেছে। এবার একটি হাতির মৃত্যুর তথ্য খুঁজতে গিয়ে পাওয়া গেছে সিংহী ও ওয়াইল্ডবিস্টের মৃত্যুর খবর।
বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে রাখা অসুস্থ বুনো হাতিটি মারা গেছেচিকিৎসাধীন অসুস্থ বুনো হাতিটি। গত শুক্রবার কক্সবাজারের ডুলাহাজারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে
একাধিক সূত্রে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, গত বছরের ১৯ নভেম্বর একটি ওয়াইল্ডবিস্ট ও একই বছরের ডিসেম্বর মাসে একটি সিংহীর মৃত্যু হয়েছে। এসব তথ্য এতদিন গোপন রাখেন সাফারি পার্কের কর্মকর্তারা। গত ২১ ডিসেম্বর একটি হাতির মৃত্যুর তথ্যও প্রথমে প্রকাশ করা হয়নি। পরে থানায় দায়ের করা জিডি থেকে ঘটনার ১১দিন পর বিষয়টি জানাজানি হয়।
তথ্যগুলো নিয়ে গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় কথা হয় সাফারি পার্কের প্রকল্প পরিচালক ইমরান আহমেদের সঙ্গে। এর মধ্যে সিংহীর মৃত্যুর বিষয়টি স্বীকার করেছেন তিনি। তাঁর দাবি, সিংহীটির বয়স হয়েছিল। এটি ছিল শারীরিকভাবে অত্যন্ত দুর্বল। প্রাণীটির মৃত্যুর পর এর ময়নাতদন্ত করা হয়েছে। তদন্তে প্রাণীটি হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছে বলে জানতে পেরেছেন তাঁরা। পরীক্ষা–নিরীক্ষায় সিংহীটির মধ্যে কোনো ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া বা ছোঁয়াচে রোগের উপসর্গ পাওয়া যায়নি বলে জানান ইমরান আহমেদ।
গাজীপুরে বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে লেমুরের মৃত্যু
লেমুর
ওয়াইল্ডবিস্টের মৃত্যুর কারণ জানতে চাইলে ইমরান আহমেদ বলেন, ওয়াইল্ডবিস্ট মারা গেছে কি না, বিষয়টি তাঁর জানা নেই। তবে গাজীপুরের সহকারী পুলিশ সুপার (কালিয়াকৈর সার্কেল) আজমীর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, শ্রীপুর থানায় গত ২০ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে ওয়াইল্ডবিস্টের মৃত্যুর বিষয়ে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) হয়েছে। সেখানে ১৯ নভেম্বর একটি ওয়াইল্ডবিস্টের মৃত্যুর বিষয়টি উল্লেখ আছে। জিডি করেছেন পার্কের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম।
সিংহী ও ওয়াইল্ডবিস্টের মৃত্যু প্রসঙ্গে কথা বলতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রফিকুল ইসলামের মুঠোফোন নম্বরে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি ধরেননি। তাই এ বিষয়ে তাঁর কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে প্রাণী মৃত্যুর তথ্যগুলো গোপন রাখার প্রবণতা আগেও দেখা গেছে। গত বছরের ২ জানুয়ারি থেকে ৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সাফারি পার্কে ১১টি জেব্রা, একটি বাঘ ও একটি সিংহী মারা যায়। এসব প্রাণী মারা গেলেও সে সময় সংশ্লিষ্ট থানায় জিডি করা হয়নি। এমনকি বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া প্রাণীর মৃত্যুর তথ্য যাচাই করতে তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সঙ্গে গণমাধ্যমকর্মীরা বারবার যোগাযোগ করলেও তিনি এগুলো পুরোপুরি অস্বীকার করেছিলেন।
আরও পড়ুন
বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কের পশুগুলোর চিকিৎসা নিশ্চিতের সুপারিশ
গাজীপুরের শ্রীপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক
পরে স্থানীয় সংসদ সদস্য ইকবাল হোসেন প্রাণীর মৃত্যুর তথ্য যাচাইয়ের জন্য সাফারি পার্কে সশরীর উপস্থিত হন। এরপর এতগুলো প্রাণীর মৃত্যুর তথ্য গণমাধ্যম ও সাধারণ মানুষের সামনে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করে পার্ক কর্তৃপক্ষ। এরপর প্রাণী মৃত্যুর কারণ জানতে বন বিভাগসহ বিভিন্ন দপ্তর পাঁচটি তদন্ত কমিটি গঠন করে।
তদন্তে প্রাণীগুলোর মৃত্যুর কারণ হিসেবে পার্কের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের অবহেলা পাওয়া যায়। ওই ঘটনায় তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তবিবুর রহমান, বন্যপ্রাণী পরিদর্শক সরোয়ার হোসেন, বন্যপ্রাণী চিকিৎসক জুলকারনাইন মানিক ও পার্কের প্রকল্প পরিচালক জাহিদুল কবিরকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। দুজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলাও দায়ের করে বনবিভাগ।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কের একটি সূত্র পরিচয় গোপন রাখার শর্তে গতকাল সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে জানিয়েছে, গত বছরের ডিসেম্বরে ১৬ তারিখে সিংহীটির মৃত্যু হয়। এর আগে জেব্রা, সিংহ ও বাঘের মৃত্যু নিয়ে পার্ক কর্তৃপক্ষ বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছিল। ফলে এবারের তথ্য পার্কের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছাড়া অন্য কাউকে জানতে দেওয়া হয়নি। অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে সেটির ব্যবস্থাপনা করা হয়েছে। সূত্রটি আরও জানায়, পার্কের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে গণমাধ্যম কর্মীদের সঙ্গে কথা না বলতে পার্ক কার্যালয় ও বন বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কড়া নিষেধাজ্ঞা আছে।
বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে প্রাণীর মৃত্যু জীবাণুর সংক্রমণে, সিলেটে প্রাণিসম্পদমন্ত্রী
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম।
পার্কের কোনো প্রাণীর জন্ম ও মৃত্যুর তথ্যগুলো গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে প্রকাশ করার অনীহা কেন, এমন প্রশ্নের উত্তরে প্রকল্প পরিচালক ইমরান আহমেদ বলেন, ‘এগুলো আসলে প্রকাশ করার তো কিছু নেই। প্রাণী জন্ম-মৃত্যু এগুলো স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। প্রাণী মারা গেলে আমাদের ডাক্তার আছেন, বিশেষজ্ঞ আছেন, তারা পোস্টমর্টেম করেন। এগুলো স্বাভাবিক। অস্বাভাবিক কিছু হলে আমরা যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে প্রকাশ করি। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে বিষয়টি রিপোর্ট করা হয়। এমনকি স্থানীয় পর্যায়ে থানায় সাধারণ ডায়েরি করা হয়।’
সাফারি পার্ক কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, জেব্রার পাল ছিল ৩১ সদস্যের। গত বছরের শুরুর দিকে ১১টির মৃত্যুর পর পার্কে এখন আছে ২০টি জেব্রা। এ ছাড়া একটি বাঘের মৃত্যুর পর এখন তাদের পরিবার ৯ সদস্যের। সর্বশেষ গত মাসে একটি সিংহী মারা যাওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে বর্তমানে সিংহী আছে মাত্র একটি। সিংহ আছে সাতটি।